জীবনে এমন অনেক সময় আসে, যখন মনে হয় যেন সবকিছু থেমে গেছে। চারপাশে শুধুই অন্ধকার, হতাশা আর ভয়। কাজের চাপ, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা, সব কিছু একসঙ্গে এসে যেন মনটাকে বিদ্ধ করে। এমন সময়ে, আমরা সকলেই আলোর সন্ধান করি। কিন্তু সেই আলো কোথায় পাব? কীভাবে পাব?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে আমরা আজ হাত বাড়াব গীতার দিকে। হাজার বছরের পুরনো এই জ্ঞানগ্রন্থ আমাদের জীবনের দিশারি হতে পারে। গীতা শুধুই ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি জীবন বাঁচার এক অসাধারণ গাইড। আসুন, গীতার ৫টি মন্ত্র নিয়ে আলোচনা করি, যা আপনাকে জীবনের অন্ধকার সময়ে পথ দেখাবে।
১. কর্মণ্যে বসাধিকারস্তে – কাজেই তোমার অধিকার, ফলের নয়
আমাদের জীবনের অনেক সমস্যা আসে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে। আমরা কাজ করার আগেই তার ফল নিয়ে ভেবে বসি। যদি না পারি? যদি সফল না হই? এই চিন্তা আমাদের অকারণ চাপ দেয়।
গীতা বলে, “তোমার অধিকার শুধু তোমার কাজে, কিন্তু কাজের ফল নিয়ে নয়। ফলের চিন্তা তোমার কাজের উৎসাহ কমিয়ে দেয়।”
পরামর্শ:
- নিজের লক্ষ্যকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করুন। প্রতিটি ধাপ শেষ করার পর নিজেকে পুরস্কৃত করুন।
- কাজের ফল নিয়ে বেশি ভাববেন না। শুধু চেষ্টা করুন এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখুন।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনি একটি পরীক্ষা দিচ্ছেন। যদি আপনি ফল নিয়ে বেশি ভাবেন, তবে পড়ার সময়ও আপনি চাপে থাকবেন। বরং প্রতিদিন পড়ার একটি রুটিন তৈরি করুন এবং ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করার আনন্দ উপভোগ করুন।
২. যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি – স্থির চিত্তে কাজ করো
কখনও কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন উদ্বিগ্ন থাকি তখন ভালো কাজ করতে পারি না? স্থির মনের গুরুত্ব এখানে অপরিসীম। গীতা বলছে, “যদি মন শান্ত ও স্থির থাকে, তবে তুমি যে কাজই করো, সেটি সফল হবে।”
পরামর্শ:
- মেডিটেশন বা ধ্যান করার অভ্যাস করুন।
- সকালে অন্তত ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিন।
- নিজের অনুভূতিগুলো লিখে রাখুন। এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
উদাহরণ:
আপনার যদি কোনো প্রেজেন্টেশন থাকে, তবে তার আগে পাঁচ মিনিট শান্ত হয়ে গভীর শ্বাস নিন। দেখবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে এবং আপনার কথা বলার ধরণে স্থিরতা আসবে।
৩. সামত্বং যোগ উচ্যতে – সমতার মাধ্যমে জীবনে ভারসাম্য আনো
জীবনে কখনও খারাপ সময় আসবেই। সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, সফলতা-ব্যর্থতা, সবই জীবনের অংশ। গীতা বলছে, “সবকিছুকে সমানভাবে গ্রহণ করাই হল যোগ।”
অর্থাৎ, সুখে অহংকারী হওয়া নয়, আবার দুঃখে ভেঙে পড়া নয়।
পরামর্শ:
- জীবনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলিকে উদযাপন করুন।
- ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন এবং এগিয়ে যান।
- নিজেকে বোঝান যে, জীবনের ভালো-মন্দ উভয়ই অস্থায়ী।
উদাহরণ:
আপনি যদি কোনো খেলায় হেরে যান, তখন সেটিকে শুধু একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখুন। নতুন কৌশল শিখুন এবং পরবর্তী খেলায় আরও ভালো করার জন্য প্রস্তুতি নিন।
৪. অভয়ং সত্ত্বসম্পত্তি – ভয়কে জয় করো
ভয় আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। গীতা বলছে, “ভয় ত্যাগ করো, কারণ এটি তোমার মন ও শরীরকে দুর্বল করে।” ভয় আমাদের অনেক ভালো সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।
পরামর্শ:
- নিজেকে প্রতিদিন মনে করান, আপনি যা করতে পারেন তা অন্য কেউ করতে পারবে না।
- ছোট ছোট সাহসী পদক্ষেপ নিন।
- ভুল করার ভয়কে জয় করুন। ভুলই শেখার প্রথম ধাপ।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনি জনসমক্ষে কথা বলতে ভয় পান। প্রথমে একটি ছোট দলকে সামনে রেখে কথা বলার চেষ্টা করুন। ধীরে ধীরে আপনার ভয় কমে যাবে।
৫. আত্মানং বিদ্ধি – নিজেকে চিনুন
গীতা বলছে, “নিজেকে চিনতে পারা হল জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি।” আমরা অনেক সময় অন্যের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করি এবং হতাশ হই। কিন্তু গীতা শেখায়, প্রত্যেক মানুষ অনন্য। নিজেকে জানুন, নিজের শক্তি ও দুর্বলতাগুলো চিনুন।
পরামর্শ:
- আপনার পছন্দ-অপছন্দের একটি তালিকা তৈরি করুন।
- দিনের শেষে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, “আমি আজ কী শিখলাম?”
- আপনার শক্তিগুলোর ওপর বেশি ফোকাস করুন।
উদাহরণ:
আপনি যদি পেইন্টিং ভালো পারেন, তবে সেটি নিয়েই বেশি সময় দিন। অন্য কেউ গান ভালো গায় বলে আপনি সেটি করার চেষ্টা করবেন না। আপনার নিজস্ব দক্ষতা আপনার পরিচয়।
গীতার আলোয় এগিয়ে চলুন
অন্ধকার সময় জীবনে আসবেই, কিন্তু গীতার এই মন্ত্রগুলো আপনাকে দেখাবে কীভাবে সেই অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথে এগিয়ে যেতে হয়। মনে রাখবেন, ব্যর্থতা একটি সাময়িক অধ্যায় মাত্র, এটি আপনার পুরো জীবনের গল্প নয়।
আজ থেকেই গীতার এই শিক্ষা গুলোকে জীবনের অংশ বানান।
- কাজের ফল নিয়ে ভাবা বন্ধ করুন।
- মনকে শান্ত রাখুন।
- জীবনের ওঠানামাকে মেনে নিন।
- ভয়কে জয় করুন।
- নিজেকে চিনুন।
যতই কঠিন সময় আসুক, মনে রাখবেন, “আপনি একা নন।” আপনার ভেতরে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, তা জাগ্রত করুন। সেই শক্তিই আপনাকে জীবনের যে কোনো পরিস্থিতি থেকে বের করে আনবে।