আমাদের চারপাশে অহংকারের উপস্থিতি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিনই দেখি কে বেশি সুন্দর, কে বেশি ধনী, কার ক্যারিয়ার কতটা সফল, এ সবকিছু যেন এক অনন্ত প্রতিযোগিতা! আমরা নিজেদেরকে প্রমাণ করতে গিয়ে কখন যে অহংকারের শিকার হই, তা টের পাই না। অথচ, আমাদের জীবনযাত্রায় ভালোবাসা থাকলে সম্পর্ক আরও মধুর হতো, আর অহংকারের দেয়াল আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়।
ভগবদ্গীতা আমাদের অহংকার ত্যাগ করে ভালোবাসার পথে চলতে দারুণ কিছু শিক্ষা দিয়েছে। আসুন দেখি, কীভাবে আমরা অহংকার কমিয়ে ভালোবাসাকে বাড়াতে পারি।
১. অহংকার কীভাবে ভালোবাসাকে নষ্ট করে?
অহংকার আমাদের মনে কৃত্রিম শ্রেষ্ঠত্বের ভাব আনে, যেখানে আমরা মনে করি, “আমি সবার চেয়ে ভালো,” বা “আমার কথাই ঠিক।” এর ফলে আমরা অন্যদের অনুভূতি ও মতামতকে অবহেলা করি, আর সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়।
ভগবদ্গীতায় (১৬.৪) কৃষ্ণ বলেন: “অহংকার, ঔদ্ধত্য, আত্মম্ভরিতা, ক্রোধ, কঠোরতা ও অজ্ঞান, এই ছয়টি হলো অসুরী গুণ।”
অর্থাৎ, অহংকার আমাদের সত্যিকারের সুখ থেকে বঞ্চিত করে এবং সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়।
২. নরম হওয়ার অর্থ দুর্বল হওয়া নয়
আমাদের সমাজে একটা বড় ভুল ধারণা আছে, “যে বেশি নম্র, সে দুর্বল।” কিন্তু ভগবদ্গীতার দৃষ্টিকোণ থেকে নম্রতা হলো আসল শক্তি। কৃষ্ণ (১৩.৮) বলেন: “অহিংসা, সত্যবাদিতা, ক্রোধ সংবরণ, বিনয়, এসব গুণ অর্জন করলে জ্ঞান অর্জিত হয়।”
অহংকার ছেড়ে নম্র হলে আমরা আত্মবিশ্বাস হারাই না, বরং আরও বেশি প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠি।
৩. নিজের ভুল স্বীকার করুন, এটাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের লক্ষণ
কখনো কি অনুভব করেছেন, “আমার ভুল স্বীকার করলে লোকে আমাকে ছোট ভাববে”? আসলে, এই চিন্তাটাই অহংকারের প্রতিচ্ছবি। বাস্তবে, ভুল স্বীকার করলে মানুষ আমাদের আরও বেশি শ্রদ্ধা করে।
ভগবদ্গীতার (২.৭) শ্লোকে অর্জুন বলেন: “আমি দিশেহারা! তুমি বলো কী আমার জন্য ভালো, আমি তা মেনে চলতে প্রস্তুত।”
অর্জুন যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি বিভ্রান্ত, তখনই তিনি কৃষ্ণের সাহায্য চাইলেন। তিনিও যদি অহংকারে থাকতেন, তবে কখনোই সঠিক পথ খুঁজে পেতেন না।
৪. কৃতজ্ঞতা চর্চা করুন
কৃতজ্ঞতা হলো অহংকার দূর করার শ্রেষ্ঠ উপায়। অহংকারী ব্যক্তি ভাবে, “আমিই সব করেছি,” কিন্তু কৃতজ্ঞ ব্যক্তি বোঝে যে জীবন আসলে অনেকের অবদানে তৈরি।
ভগবদ্গীতায় (৩.১১) কৃষ্ণ বলেন: “যদি আমরা পরস্পরকে সাহায্য করি, তবে দেবতারা আমাদের আশীর্বাদ দেবে এবং আমরা সুখী হব।”
যখন আমরা কৃতজ্ঞ থাকি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভেতরে ভালোবাসা বেড়ে যায়, আর অহংকার কমে।
৫. অহংকার ছাড়ার জন্য কিছু কার্যকর অভ্যাস
এখন প্রশ্ন হলো, অহংকার ত্যাগ করে ভালোবাসা কীভাবে বাড়ানো যায়? ভগবদ্গীতার শিক্ষাগুলো অনুসরণ করে কিছু অভ্যাস গড়ে তুললে আমরা সহজেই এই পরিবর্তন আনতে পারি।
(১) প্রতিদিন নিজেকে মনে করিয়ে দিন: “আমি নিখুঁত নই, আমিও ভুল করতে পারি।”
(২) অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন: অহংকারী ব্যক্তিরা অন্যদের কথা শোনে না। মনোযোগ দিয়ে শুনলে সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
(৩) কৃতজ্ঞতার তালিকা তৈরি করুন: প্রতিদিন রাতে তিনটি বিষয় লিখুন, যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ।
৪) পরোপকার করুন: বিনা স্বার্থে কাউকে সাহায্য করলে অহংকার কমে যায়।
(৫) ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত থাকুন: কৃষ্ণ বলেন, “নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করো, আমি তোমার সমস্ত বোঝা বহন করব।” (১৮.৬৬)
উপসংহার: অহংকার ছেড়ে ভালোবাসার পথ বেছে নিন
জীবনে সুখী হতে হলে অহংকার কমিয়ে ভালোবাসার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। নম্রতা, কৃতজ্ঞতা ও পরোপকারের মাধ্যমে আমরা এটা অর্জন করতে পারি।
আজ থেকেই ছোট ছোট পরিবর্তন শুরু করুন। অহংকার ছেড়ে দিন, ভালোবাসার আলোয় জীবন ভরিয়ে তুলুন। কৃষ্ণের উপদেশ আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের শক্তি নম্রতায়, আর সত্যিকারের সাফল্য আসে অহংকারহীন ভালোবাসা থেকে।