আমাদের প্রতিদিনের জীবনে খুশি থাকা যেন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। পড়াশোনা, চাকরি, সম্পর্কের চাপ বা ভবিষ্যতের চিন্তা – এই সবকিছু মিলিয়ে মন যেন এক অজানা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। এর মাঝে, আমরা প্রায়ই ভুলে যাই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আর আনন্দ খুঁজে পাওয়ার উপায়। এই সমস্যার সমাধানে হাজার বছর আগের লেখা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের জন্য অসাধারণ কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়। গীতার এই শিক্ষা আজকের আধুনিক যুবসমাজের জন্যও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
চলুন, গীতার আলো থেকে ৮টি শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করি, যা আপনাকে জীবনে আনন্দ পেতে সাহায্য করবে।
১. কর্ম করো, ফলের প্রত্যাশা করো না
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“কর্মণ্যে বাধিকারে স্তে মা ফলেষু কদাচন।”
এটার মানে হলো, আমরা শুধুমাত্র আমাদের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, কিন্তু ফলাফল আমাদের হাতে নেই।
উদাহরণ: ধরুন আপনি একটি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন। আপনি যদি শুধু ভালো রেজাল্টের চিন্তায় দিন কাটান, তাহলে দুশ্চিন্তা আপনাকে গ্রাস করবে। বরং, নিজের সেরা চেষ্টা করুন এবং ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। এটি আপনাকে চাপমুক্ত রাখবে।
২. আপনার প্রকৃত শক্তি চিনুন
শ্রীকৃষ্ণ আমাদের বলেছেন, প্রতিটি মানুষের ভিতরেই আলাদা আলাদা ক্ষমতা রয়েছে। নিজের দক্ষতা ও শক্তি চিনতে শিখুন।
উদাহরণ: ধরুন আপনার বন্ধু হয়তো অসাধারণ শিল্পী, আর আপনি ভালো বক্তা। নিজের গুণাবলী চিনে নিয়ে তাতে মনোযোগ দিন। নিজের দক্ষতা দিয়ে নিজের পথ তৈরি করুন।
৩. মানসিক শান্তি পেতে অহংকার ত্যাগ করুন
গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে অহংকার আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে। সত্যিকারের আনন্দ পেতে আমাদের অহংকার ত্যাগ করতে হবে।
উদাহরণ: মনে করুন আপনি একটি গ্রুপ প্রজেক্টে কাজ করছেন। অহংকারের কারণে যদি আপনি মনে করেন আপনি সবকিছু জানেন, তাহলে দলগত কাজ ব্যাহত হবে। কিন্তু যদি নম্রতা দেখান, আপনার দলের সবার থেকে কিছু না কিছু শিখতে পারবেন।
৪. প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখুন
গীতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা। আমরা যতই বাইরে থেকে সুখ খুঁজতে যাই না কেন, প্রকৃত আনন্দ আমাদের অন্তরে থাকে।
উদাহরণ: আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় আমরা প্রকৃতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছি। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন পার্কে হাঁটুন বা গাছের নীচে সময় কাটান। দেখবেন, আপনার মানসিক শান্তি ফিরে আসছে।
৫. নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করুন
গীতায় বলা হয়েছে, আনন্দ এবং দুঃখ – দুটোই জীবনের অংশ। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা উচিত।
উদাহরণ: ধরুন কোনো কাজ ব্যর্থ হয়েছে। এতে হতাশ না হয়ে নিজের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিন। আবার, সফল হলে অহংকার করবেন না। স্থিতিশীল মানসিকতা বজায় রাখুন।
৬. ধর্ম মানে দায়িত্ব
গীতায় ধর্ম বলতে দায়িত্ব বোঝানো হয়েছে। আমাদের উচিত নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা।
উদাহরণ: আপনি যদি ছাত্র হন, তাহলে আপনার ধর্ম হলো পড়াশোনা করা। আবার, যদি আপনি কারও বন্ধু হন, তাহলে তার পাশে থাকা আপনার দায়িত্ব। দায়িত্ব পালন থেকেই আসল আনন্দ।
৭. কৃতজ্ঞ থাকুন
শ্রীকৃষ্ণ বারবার আমাদের জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন। এটি জীবনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আনে।
উদাহরণ: ধরুন আপনার ফোন বা ইন্টারনেট নেই। হয়তো দিনটি আপনার জন্য অস্বস্তিকর হবে। কিন্তু ভাবুন, আপনার কাছে খাবার, পানি, এবং ছাদ আছে – এগুলো নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকুন। কৃতজ্ঞতাই সুখের মূল চাবিকাঠি।
৮. মনে শক্তি রাখুন, ভয়কে জয় করুন
গীতায় বলা হয়েছে, ভয় হচ্ছে অজ্ঞানতার ফল। ভয়কে জয়ের জন্য আত্মবিশ্বাস তৈরি করুন।
উদাহরণ: ধরুন, আপনি একটি নতুন কাজ শুরু করতে ভয় পাচ্ছেন। ভয়কে জয় করতে ধাপে ধাপে এগোন। ভয়কে প্রতিদিন একটু একটু করে জয় করার চেষ্টা করুন।
গীতার শিক্ষা, জীবনের আলো
গীতার এই শিক্ষাগুলো যদি জীবনে কাজে লাগানো যায়, তাহলে আমাদের জীবন অনেক বেশি সুখময় হবে। মনে রাখবেন, আনন্দ খুঁজতে বাইরে যেতে হবে না। এটি আপনার নিজের মন এবং কাজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
আজ থেকেই চেষ্টা করুন গীতার এই শিক্ষাগুলোকে জীবনে প্রয়োগ করার। প্রতিদিন একটি ছোট পদক্ষেপ নিন – যেমন, সকালে উঠে ৫ মিনিট কৃতজ্ঞতা জানানো বা প্রতিদিনের কাজে নিজের সেরা চেষ্টা করা।
মনে রাখবেন:
“নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনাই জীবনের প্রকৃত জয়।”