ক্যারিয়ারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গীতার ৯টি নির্দেশিকা

জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হই, বিশেষ করে আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে। ক্যারিয়ার নির্বাচন, পরিবর্তন, বা উন্নতির ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের ভবিষ্যতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অনেক সময় আমরা দ্বিধায় পড়ি, কোন পথে এগোব, কোনটি আমাদের জন্য সঠিক। এই পরিস্থিতিতে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা আমাদের জন্য একটি মূল্যবান নির্দেশিকা হতে পারে। গীতার শিক্ষাগুলো আজকের যুবসমাজের জন্যও প্রাসঙ্গিক। আসুন, গীতার আলোকে ক্যারিয়ারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৯টি নির্দেশিকা বিবেচনা করি।

১. স্বধর্মে স্থিত থাকা

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ” (গীতা ৩.৩৫)। অর্থাৎ, নিজের ধর্ম বা কর্তব্য পালন করাই শ্রেষ্ঠ; অন্যের ধর্ম পালন বিপজ্জনক। ক্যারিয়ারে এটি প্রযোজ্য যে, নিজের দক্ষতা, আগ্রহ এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশা নির্বাচন করা উচিত। অন্যের প্রভাব বা সামাজিক চাপে পড়ে এমন পেশা বেছে নেওয়া যা আপনার সঙ্গে মানানসই নয়, তা ভবিষ্যতে অসন্তোষের কারণ হতে পারে।

উদাহরণ: রাহুলের পরিবার চেয়েছিল সে ডাক্তার হোক, কিন্তু তার আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে। পরিবারের চাপে ডাক্তারি পড়লেও, পরে সে সঙ্গীতকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয় এবং সফল হয়। কারণ, সঙ্গীতই ছিল তার স্বধর্ম।

২. আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা

গীতায় উল্লেখ আছে, “অশান্তস্য কুতঃ সুখম্?” (গীতা ২.৬৬) অর্থাৎ, যার মন অশান্ত, সে কোথায় সুখ পাবে? ক্যারিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত উত্তেজনা বা হতাশার মুহূর্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রায়ই ভুল হয়। শান্ত মনেই সঠিকভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।

উদাহরণ: মিতা হঠাৎ করেই তার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল একটি ছোট সমস্যার কারণে। কিন্তু কিছুদিন পর সে বুঝতে পারে, আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিলে তা ভুল হতে পারত। শান্ত থেকে সমস্যার সমাধান করাই ছিল সঠিক পথ।

৩. ফলের আসক্তি ত্যাগ করা

শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” (গীতা ২.৪৭) অর্থাৎ, তোমার অধিকার শুধু কর্মে, ফলে নয়। ক্যারিয়ারে আমরা প্রায়ই ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হই, যা আমাদের মানসিক চাপ বাড়ায়। কিন্তু যদি আমরা কাজে মনোনিবেশ করি এবং ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করি, তাহলে কর্মের মান বৃদ্ধি পায় এবং সফলতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসে।

উদাহরণ: সুমন একটি প্রজেক্টে কাজ করছিল শুধুমাত্র প্রমোশনের আশায়। ফলে তার কাজে মান কমে যায়। কিন্তু যখন সে কাজে মনোনিবেশ করে এবং ফল নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে, তখন তার পারফরম্যান্স উন্নত হয় এবং প্রমোশনও পায়।

৪. ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ

গীতায় বলা হয়েছে, “যততো হ্যপি কাউন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ, ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ” (গীতা ২.৬০) অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়গুলি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তির মনকেও প্রলুব্ধ করতে পারে। ক্যারিয়ারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে ইন্দ্রিয়ের প্রলোভন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে আমরা সহজেই ভুল পথে চলে যেতে পারি।

উদাহরণ: রোহিত উচ্চ বেতনের লোভে এমন একটি চাকরি গ্রহণ করে যেখানে তার নৈতিকতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরে সে বুঝতে পারে, ইন্দ্রিয়ের প্রলোভনে পড়ে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

৫. মায়া ত্যাগ করা

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মায়া ত্যাগ করতে উপদেশ দেন, যা আমাদের আসক্তি ও বন্ধন থেকে মুক্ত করে। ক্যারিয়ারে আমরা প্রায়ই পরিচিত পরিবেশ বা নিরাপত্তার মায়ায় আটকে থাকি, যা আমাদের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। মায়া ত্যাগ করে নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।

উদাহরণ: সীমা তার কমফোর্ট জোন ছেড়ে নতুন শহরে চাকরি গ্রহণ করে। প্রথমে কঠিন মনে হলেও, পরে সে বুঝতে পারে এটি তার ক্যারিয়ারের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

৬. ধৈর্য ধারণ করা

গীতায় উল্লেখ আছে, “সমদুঃখসুখং ধীরং সোমৃতত্বায় কল্পতে” (গীতা ২.১৫) অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সুখ-দুঃখে সমান থাকে, সে অমৃতত্বের যোগ্য। ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন আসবেই; ধৈর্য ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়াই সাফল্যের চাবিকাঠি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top