আজকের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো – “আমি কি করে সত্যিকারের সুখ খুঁজে পাবো?” আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডে স্ক্রল করতে করতে, ক্যারিয়ারের চাপের মাঝে অথবা সম্পর্কের জটিলতায় আটকে থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। কিন্তু সত্যি কি আমরা সেই সুখের সন্ধান পাচ্ছি? বাস্তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সাময়িক আনন্দে বিভোর থাকি, কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার সেই পুরনো শূন্যতা ফিরে আসে।
ভগবদ্গীতা, যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে, এতে রয়েছে চিরস্থায়ী সুখের চাবিকাঠি। তাহলে চলুন, দেখি কীভাবে গীতার আলোকে আমরা আমাদের জীবনে প্রকৃত সুখ পেতে পারি।
সমস্যা: আমরা সুখকে ভুল জায়গায় খুঁজি
আমাদের বর্তমান জীবনে সুখের সংজ্ঞা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের জিনিসের ওপর নির্ভরশীল। নতুন গ্যাজেট, চাকরি, সম্পর্ক, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার লাইকের সংখ্যা – এগুলোর মধ্যে আমরা সুখ খুঁজি। কিন্তু যখন এগুলো আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে না, তখন আমরা হতাশ হই।
গীতা এই সমস্যা সম্পর্কে বলে –
“যে ব্যক্তি সুখের সন্ধান তার বাহ্যিক বস্তুতে করে, সে কখনোই সত্যিকারের শান্তি পাবে না।” (গীতা ৫.২২)
বাইরের বস্তুগুলো ক্ষণস্থায়ী, আর সেই কারণেই এগুলো আমাদের মনকে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি দিতে পারে না। প্রকৃত সুখ আসে যখন আমরা আত্মাকে চিনি এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করি।
গীতার সমাধান: কর্মযোগের পথে এগোন
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে মহা উপদেশ দিয়েছেন তার অন্যতম মূল শিক্ষা হলো কর্মযোগ। কর্মযোগ মানে কোনো কিছু পাওয়ার আশা ছাড়াই কাজ করা। আমরা যদি আমাদের কাজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিই এবং ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা না করি, তাহলে আমাদের মন শান্ত থাকবে।
“কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু ফলের আশা তোমার অধিকার নয়।” (গীতা ২.৪৭)
এই দর্শন গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা যেকোনো কাজকে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, যদি তুমি পড়াশোনা করো শুধুমাত্র ভালো নম্বরের আশায়, তাহলে তা মানসিক চাপের কারণ হবে। কিন্তু যদি তুমি পড়াশোনাকে শেখার আনন্দে করো, তাহলে তা এক নতুন অর্থ পাবে।
সমাধান: আত্মচিন্তনের মাধ্যমে সুখ খুঁজুন
গীতা শিক্ষা দেয় আত্মজ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব। আমরা যখন নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি, তখন বাহ্যিক জিনিসগুলোর ওপর নির্ভরতা কমে যায় এবং একটি স্থায়ী শান্তি অনুভব করি।
প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান করুন, নিজেকে জানার চেষ্টা করুন এবং জীবনের সত্য উদ্দেশ্য কী তা বোঝার চেষ্টা করুন। গীতায় বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি আত্মাকে জানতে পেরেছে, তার কাছে সুখ এবং দুঃখ সমান।” (গীতা ৬.২০-২১)
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
ধরা যাক, তুমি একটা বড় পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছো, এবং তুমি খুব নার্ভাস। যদি তুমি ফলাফল নিয়ে চিন্তিত হও, তাহলে চাপ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু যদি তুমি মনে রাখো যে তোমার কর্তব্য হলো শুধু ভালোভাবে পড়া এবং নিজের সেরা দেওয়া, তাহলে তোমার পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা বাড়বে এবং চাপ কমবে।
অন্য একটি উদাহরণ হতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হওয়ার দৌড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। যদি তুমি শুধু নিজের উন্নতির জন্য কাজ করো, তাহলে বাহ্যিক স্বীকৃতির প্রয়োজন কমে যাবে এবং তুমি আরো সুখী হবে।
গীতার ৩টি সহজ জীবনের উপদেশ
১. নিষ্কাম কর্ম করুন – কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই কাজ করুন এবং নিজের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিন।
2. নিজের সত্ত্বাকে জানুন – আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে সত্যিকারের সুখের সন্ধান করুন।
3. সংযম ও ধৈর্য বজায় রাখুন – জীবনের উত্থান-পতন স্বাভাবিক, এগুলোকে হাসিমুখে গ্রহণ করতে শিখুন।
সুখ আমাদের মনোভাবের মধ্যে
চিরস্থায়ী সুখ কোনো বাহ্যিক বস্তুতে নেই, এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে লুকিয়ে আছে। গীতার শিক্ষা যদি আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে আমরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে শান্তি ও আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারবো।
আজ থেকেই শুরু করুন – নিজের কাজকে ভালোবাসুন, ফলাফলের চিন্তা বাদ দিন, এবং আত্ম-উন্নতির পথে এগিয়ে যান। তবেই প্রকৃত সুখের সন্ধান মিলবে।