জীবনের কোনো এক সময় আমরা সবাই হয়তো এমন একটা মুহূর্তে পৌঁছে যাই, যখন মনে হয়, “আমার কি কোনো গুরুত্ব আছে?” কিংবা “কেউ কি আমাকে সত্যিই বুঝতে চায়?” এমন অনুভূতি স্বাভাবিক, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এভাবে ভাবলে মানসিক চাপ এবং হতাশার শিকার হওয়া অসম্ভব নয়। ভাগ্যক্রমে, আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র ‘ভগবদ গীতা’ এই বিষয়ে অসাধারণ সমাধান প্রদান করে। চলুন, গীতার ছয়টি সহজ শিক্ষা দিয়ে আমরা কীভাবে এই অবহেলিত অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে পারি, তা জানি।
১. নিজেকে জানতে হবে – “আত্মানং বিদ্ধি”
গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “তোমার প্রকৃতি এবং কর্মফল বুঝতে শেখো। নিজেকে জানার মধ্যে মুক্তির সূত্রপাত।” যদি তুমি নিজেই না জানো তুমি কে এবং কী চাও, তাহলে অন্যরা তোমার গুরুত্ব বুঝবে কীভাবে?
যা করতে পারো: প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট সময় নিয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে ভাবো। একটা জার্নালে লিখে রাখো। এটা তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।
২. কর্মে ফোকাস করো, ফলে নয় – “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে”
শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, “তোমার কর্তব্য শুধু কাজ করা, ফল নিয়ে চিন্তা করো না।” জীবনে অনেক সময় আমরা অন্যের স্বীকৃতির উপর বেশি নির্ভর করি। কিন্তু আসল শক্তি হলো নিজের কাজে আনন্দ খুঁজে পাওয়া।
যা করতে পারো: এমন কাজ বেছে নাও যা তোমাকে সত্যিই খুশি করে। পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে মন খারাপ না করে শেখার উপর মন দাও। তোমার প্রচেষ্টাই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৩. সংসারকে দায়িত্বের চোখে দেখো – “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি”
শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, “যোগ বা স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থায় থেকে তোমার কাজ করো।” যখন আমরা দায়িত্ব এড়িয়ে চলি, তখন অনেক সময় নিজেকে অবহেলিত মনে হয়।
যা করতে পারো: নিজের দৈনন্দিন কাজগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে করো। মনে রাখো, ছোট কাজও জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি তোমার বন্ধু বা পরিবার তোমার উপর নির্ভর করে, তাহলে তাদের সাহায্য করো।
৪. সৎ সঙ্গের প্রভাব – “সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামাঃ”
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “তোমার সঙ্গ তোমার চরিত্র গঠন করে।” খারাপ সঙ্গত থেকে নিজেকে দুর্বল মনে হতে পারে। আবার, ভালো সঙ্গ তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
যা করতে পারো: এমন বন্ধু তৈরি করো যারা তোমাকে উৎসাহিত করে। যেসব মানুষ তোমার আত্মসম্মান নষ্ট করে, তাদের থেকে দূরে থাকো। ভালো বই পড়ো বা অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও দেখো।
৫. আত্মসম্মান এবং সেবার মানসিকতা – “পরমার্থায় চ ক্রিয়াঃ”
গীতার শিক্ষা হলো, জীবনের প্রকৃত অর্থ হলো অন্যের সেবা করা। যখন তুমি অন্যের উপকারে আসো, তখন নিজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারো।
যা করতে পারো: প্রতিদিন ছোট ছোট ভালো কাজ করো। যেমন: কারো মুখে হাসি ফোটানো, নিজের পকেটমানি থেকে কিছু দান করা, বা কাউকে সাহায্য করা। এতে তুমি নিজেকে আরও মূল্যবান মনে করবে।
৬. মনে রেখো, তুমি চিরন্তন – “ন হন্যতে হন্যমানেঃ শরীরে”
গীতার একেবারে মৌলিক শিক্ষা হলো, “আমরা কেবল শরীর নই, আমরা আত্মা। আত্মাকে ধ্বংস করা যায় না।” নিজেকে সাময়িক অবস্থার সঙ্গে মেলালে অবহেলিত অনুভূতি বাড়বে। কিন্তু যখন বুঝবে, তোমার আসল সত্তা অমর, তখন শক্তি পাবে।
যা করতে পারো: যোগাসন, ধ্যান বা প্রার্থনা করো। নিজেকে বড় কিছুর অংশ মনে করো। এতে তোমার মধ্যে স্থিতি আসবে।
বাস্তব উদাহরণ
তুমি হয়তো এমন পরিস্থিতিতে আছো, যেখানে বন্ধু বা পরিবার তোমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভাবো, যদি অর্জুনও সেইভাবে হতাশায় ডুবে থাকতেন এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ না শুনতেন, তাহলে কি তিনি কুরুক্ষেত্রে জয়লাভ করতে পারতেন? তোমার জীবনেও এমন চ্যালেঞ্জ আসবে। গীতার এই শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করে দেখো।
শুরু করো আজ থেকেই
জীবনে অনেক সময় নিজেকে অবহেলিত মনে হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চাবিকাঠি তোমার হাতেই। গীতার এই ৬টি শিক্ষা তোমার মনোভাবকে পাল্টে দিতে পারে। প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাও। মনে রেখো, “তুমি নিজেই তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু।” আজ থেকেই নিজেকে ভালোবাসা শুরু করো, গীতার পথে এগিয়ে চলো।