আমরা অনেক সময় একসাথে অনেক কিছু করতে চাই। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট, অফিসের ডেডলাইন, পারিবারিক দায়িত্ব, এবং ব্যক্তিগত স্বপ্ন, সবই যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। কিন্তু, কাজগুলো সঠিক সময়ে করতে না পারলে চাপ বাড়ে, আর এর প্রভাব পড়ে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে।
গীতার শিক্ষা আমাদের কী বলে?
ভগবদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা শুধু মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়; আজকের আধুনিক জীবনের জন্যও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শেখান, কর্মযোগ, অর্থাৎ কাজের প্রতি সঠিক মনোভাব, আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাহলে, চলুন দেখি কীভাবে গীতার শিক্ষা থেকে প্রয়োজনীয় কাজগুলো আগে করার জন্য অনুপ্রেরণা নেওয়া যায়।
১. কর্মে ফোকাস করুন, ফল নিয়ে ভাবনা নয়
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
অর্থাৎ, তোমার কাজ কর, কিন্তু ফল নিয়ে বেশি চিন্তা করো না। আমরা যখন কাজের ফলাফল নিয়ে অযথা চিন্তা করি, তখনই দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়। এজন্য, কাজের দিকে মন দিন এবং ফলাফলের চিন্তা ছেড়ে দিন।
উদাহরণস্বরূপ: ধরুন, পরীক্ষার আগে অনেক পড়াশোনা বাকি। ফলাফলের চিন্তায় সময় নষ্ট না করে এক একটি বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করুন। ধীরে ধীরে সবকিছু সহজ লাগবে।
২. অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন
প্রয়োজনীয় কাজগুলো আগে করতে হলে কোন কাজ আগে করা দরকার, সেটি ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর দায়িত্ব বুঝতে সাহায্য করেছিলেন। আমরাও আমাদের দায়িত্ব এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো চিহ্নিত করতে পারি।
কৌশল:
- একটি তালিকা তৈরি করুন।
- কাজগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করুন, অত্যন্ত জরুরি, জরুরি, এবং অপেক্ষাকৃত কম জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ: যদি আপনার সামনে পড়াশোনা, ফিটনেস, এবং বিনোদন, এই তিনটি কাজ থাকে, তবে পড়াশোনা প্রথমে রাখুন। কারণ এটি আপনার ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৩. মনোযোগ বজায় রাখুন
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলেছেন, মনোযোগ এবং ধ্যান একটি ব্যক্তির শক্তি বাড়ায়। যখন আমরা একসাথে অনেক কিছু করার চেষ্টা করি, তখন একটিরও ঠিকমতো হয় না।
কৌশল:
- মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়া দূরে রাখুন।
- একসময় একটিমাত্র কাজ করুন।
উদাহরণস্বরূপ: পড়াশোনা করার সময় ফোনে নোটিফিকেশন আসলে মন বিভ্রান্ত হয়। তাই পড়ার সময় ফোনটি সাইলেন্টে রেখে পড়ুন।
৪. সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হন
শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, নিয়মিত কাজ করার মাধ্যমে জীবন সহজ হয়। প্রতিদিনের রুটিন তৈরি করুন এবং তা মেনে চলুন। এতে সময় নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
কৌশল:
- সকালে দিনের পরিকল্পনা করুন।
- বড় কাজগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করুন।
উদাহরণস্বরূপ: ৩ ঘণ্টার পড়ার কাজকে ১ ঘণ্টার তিনটি সেশনে ভাগ করুন। এতে মনোযোগ বাড়বে এবং কাজ শেষ হবে।
৫. স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখুন
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আমাদের শরীর এবং মন হল কর্মের জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এগুলোকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের দায়িত্ব। যদি আমরা ক্লান্ত বা অসুস্থ হই, তাহলে কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি না।
কৌশল:
- পর্যাপ্ত ঘুম নিন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
উদাহরণস্বরূপ: পরীক্ষার আগে অনেক রাত জাগলে শরীর দুর্বল হয় এবং পড়ার সময় ক্লান্তি আসে। তাই ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন।
৬. স্ব-প্রেরণা তৈরি করুন
গীতার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল আত্মবিশ্বাস এবং নিজের শক্তিতে বিশ্বাস। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন:
“উদ্ধরেদ আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত।”
অর্থাৎ, নিজের উন্নতির জন্য নিজেই দায়ী। অন্য কেউ তোমার জন্য কিছু করবে না।
কৌশল:
- প্রতিদিন নিজেকে মনে করান কেন এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ।
- ছোটো ছোটো সাফল্য উদযাপন করুন।
উদাহরণস্বরূপ: আজ একটি অধ্যায় শেষ করতে পারলে নিজেকে পুরস্কৃত করুন, যেমন আপনার প্রিয় সিনেমা দেখুন।
আজ থেকেই শুরু করুন
শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিখিয়েছেন, সঠিক সময় কখনও আসে না; আমরা যখন শুরু করি, সেটিই সঠিক সময়। তাই, আজ থেকেই আপনার কাজগুলোর জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আগে করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
একটি প্রস্তাবিত রুটিন:
- সকালে ১০ মিনিট ধ্যান করুন।
- দিন শুরুর আগে কাজগুলোর অগ্রাধিকার ঠিক করুন।
- এক সময়ে একটি কাজ করুন।
এই সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়গুলো আপনাকে আপনার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। মনে রাখবেন, গীতার শিক্ষা শুধুমাত্র পড়ার জন্য নয়; তা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য।