বন্ধুত্ব জীবনের অন্যতম মূল্যবান সম্পর্ক। কিন্তু যখন সেই বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন কষ্টটা সবচেয়ে বেশি হয়। মনে হয় যেন পিঠে ছুরি মারা হয়েছে! এটা ঠিক, ধাক্কাটা কঠিন, কিন্তু কীভাবে সামলানো যায়? ভগবদ্গীতা আমাদের এই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অমূল্য শিক্ষা দেয়। চলুন, দেখি কিভাবে আমরা শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসরণ করে বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা মোকাবিলা করতে পারি।
১. সংযম বজায় রাখো – (শ্লোক ২.১৪)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন:
“মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ । আগমাপায়িনো নিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ॥”
(ভগবদ্গীতা ২.১৪)
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখ সাময়িক, এগুলো সময়ের সঙ্গে আসে এবং যায়।
বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করা কঠিন, কিন্তু নিজের সংযম বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই। কিছু সময় নিজেকে দিন, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। হুট করে রাগ বা কষ্টের বশে কোনো কাজ করলে পরবর্তী সময়ে তা আরও বড় সমস্যার কারণ হতে পারে।
২. কর্ম করো, ফল নিয়ে ভাবো না – (শ্লোক ২.৪৭)
শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।”
তুমি শুধু নিজের কর্তব্য করো, ফলের চিন্তা করো না।
বিশ্বাসঘাতকতার পর তুমি কী করতে পারো? নিজের উন্নতির দিকে মন দাও।
- নিজের স্কিল বাড়াও
- পড়াশোনায় মন দাও
- শরীরচর্চা করো
- নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগ খোঁজো
নিজের উন্নতি তোমার বন্ধুকে দেখিয়ে দেবে যে তুমি তার ওপর নির্ভরশীল নও।
৩. ক্ষমা করো, কিন্তু ভুলে যেও না – (শ্লোক ১৬.৩)
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ক্ষমা মহৎ গুণ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আবার সেই একই ভুল করবে।
“অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধিঃ জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ। দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্॥”
যদি বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা তোমার জীবনে বড় ধাক্কা দেয়, তবে তাকে ক্ষমা করো নিজের শান্তির জন্য, কিন্তু একই ভুল আবার যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করো।
৪. সংযুক্ত থেকো ভালো মানুষের সাথে – (শ্লোক ৬.৫)
“উদ্ধরেদাত্মনাআত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্।”
নিজেকেই নিজেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে।
বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর জন্য যদি মন খারাপ করেই বসে থাকো, তাহলে কেবলই পিছিয়ে পড়বে। এর পরিবর্তে যারা সত্যিকারের ভালো বন্ধু, তাদের সাথে সময় কাটাও। ভালো বই পড়ো, অনুপ্রেরণামূলক মানুষদের গল্প শোনো, ইতিবাচক জিনিসে মন দাও।
৫. আসক্তি ত্যাগ করো – (শ্লোক ২.৭১)
শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“বিহায় কামান্যঃ সর্বান্ পুমাংশ্চরতি নি:স্পৃহঃ ।”
যে ব্যক্তি আসক্তি ছেড়ে নির্লিপ্তভাবে জীবন যাপন করতে পারে, সে-ই প্রকৃত শান্তি পায়।
বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার পর যদি তুমি কেবল দুঃখ নিয়ে বসে থাকো, তাহলে নিজেকেই কষ্ট দেবে। মনে রাখবে, কেউ তোমাকে কষ্ট দিলেও তুমি নিজের মানসিক শান্তির জন্য তার প্রতি আসক্ত থাকো না। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাও।
৬. নিজের প্রকৃত বন্ধু কে, সেটা বুঝতে শেখো – (শ্লোক ১৮.৬৬)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন:
“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।”
এই শ্লোকের গভীর অর্থ হলো, সঠিক আশ্রয় খুঁজে নেওয়া। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। যে বন্ধু সত্যিকারের বন্ধু, সে তোমার ভালো চায়, তোমাকে কষ্ট দেয় না।
ভুল বন্ধুদের চিনতে পারা এবং সঠিক বন্ধুদের সংরক্ষণ করাই মূল শিক্ষা।
শেষ কথা: নিজেকে হারিয়ে ফেলো না!
বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো কিছু নয়। বরং এটা তোমাকে শেখানোর জন্য আসে যে তুমি কার ওপর বিশ্বাস রাখবে।
প্রথমে ধৈর্য ধরো
নিজের উন্নতির দিকে মন দাও
ক্ষমা করো, কিন্তু বোকা হয়ে যেও না
ভালো বন্ধু খুঁজে নাও
নিজের মানসিক শান্তি রক্ষা করো
ভগবদ্গীতার শিক্ষা অনুযায়ী, প্রত্যেক সংকটই এক নতুন সুযোগ। তাই কষ্টে না ডুবে নতুনভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাও। মনে রেখো, তোমার জীবনের প্রকৃত নায়ক তুমি নিজেই!