প্রেম এবং আসক্তি, এই দুটি অনুভূতি আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তবে, আমরা অনেক সময় এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে ভুল করি, যা আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যা মানব জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে, আমাদের এই পার্থক্য বুঝতে সহায়তা করতে পারে। চলুন, গীতার পাঁচটি নির্দেশিকার আলোকে ভালোবাসা এবং আসক্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করি।
১. নিরাসক্ত কর্ম (নিঃস্বার্থ কর্ম)
গীতায় বলা হয়েছে, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” অর্থাৎ, আমাদের কর্ম করার অধিকার আছে, কিন্তু তার ফলের উপর নয়। ভালোবাসা এমনই একটি অনুভূতি যেখানে আমরা নিঃস্বার্থভাবে অন্যের মঙ্গল চাই। আসক্তি, বিপরীতে, স্বার্থপরতা এবং নিজের ইচ্ছা পূরণের দিকে ঝোঁকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা আমাদের বন্ধুর সাফল্যে আনন্দিত হই নিঃস্বার্থভাবে, তা হলো ভালোবাসা। কিন্তু যদি আমরা তাদের সাফল্যকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাই, তা আসক্তি।
২. সমত্ব (সমভাব)
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “সমত্বং যোগ উচ্যতে।” সমত্ব বা সমভাব হলো সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমানভাবে গ্রহণ করা। ভালোবাসা এই সমত্বের উপর ভিত্তি করে; এটি স্থিতিশীল এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অপরিবর্তিত থাকে। আসক্তি, তবে, পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল এবং পরিবর্তনশীল। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা কাউকে ভালোবাসি, তাদের সঙ্গে সুখে-দুঃখে থাকি, তা হলো ভালোবাসা। কিন্তু যদি আমরা শুধুমাত্র সুখের সময় তাদের সঙ্গে থাকি, তা আসক্তি।
৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ
গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে, “যঃ হি হ্যেতান্ কামান্ যঃ সর্বান্ মনোগতান্।” অর্থাৎ, যিনি ইন্দ্রিয় এবং মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত যোগী। ভালোবাসা আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়; আমরা আমাদের ইচ্ছা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই। আসক্তি, বিপরীতে, আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা আমাদের প্রিয়জনের স্বার্থে নিজেদের কিছু ইচ্ছা ত্যাগ করতে পারি, তা হলো ভালোবাসা। কিন্তু যদি আমরা নিজেদের ইচ্ছা পূরণের জন্য তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করি, তা আসক্তি।
৪. জ্ঞান ও বিবেক
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞান এবং বিবেকের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ভালোবাসা জ্ঞান এবং বিবেকের উপর ভিত্তি করে; এটি আমাদের সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে সহায়তা করে। আসক্তি আমাদের বিবেককে অন্ধ করে দেয়, যা ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা আমাদের প্রিয়জনের ভুলগুলোকে সঠিকভাবে নির্দেশ করতে পারি তাদের মঙ্গলের জন্য, তা হলো ভালোবাসা। কিন্তু যদি আমরা তাদের ভুলকে উপেক্ষা করি বা সমর্থন করি নিজেদের স্বার্থে, তা আসক্তি।
৫. মুক্তি ও স্বাধীনতা
গীতায় মুক্তি বা মোক্ষের কথা বলা হয়েছে, যা আত্মার মুক্তি নির্দেশ করে। ভালোবাসা এমন একটি অনুভূতি যা আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা দেয়; এটি আমাদের ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং স্বতন্ত্রতা সম্মান করে। আসক্তি আমাদের বেঁধে রাখে এবং আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা আমাদের প্রিয়জনকে তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য সমর্থন করি এবং তাদের স্বাধীনতা সম্মান করি, তা হলো ভালোবাসা। কিন্তু যদি আমরা তাদের আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করতে চাই, তা আসক্তি।
উপসংহার
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই নির্দেশিকাগুলো আমাদের শেখায় যে ভালোবাসা এবং আসক্তির মধ্যে সুক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, সমত্বপূর্ণ, আত্মনিয়ন্ত্রিত, জ্ঞানভিত্তিক এবং মুক্তিদায়ক। আসক্তি স্বার্থপর, পরিবর্তনশীল, নিয়ন্ত্রণহীন, অজ্ঞানতাপূর্ণ এবং বেঁধে রাখে। আমাদের উচিত এই পার্থক্যগুলো বুঝে জীবনে ভালোবাসাকে বেছে নেওয়া, যা আমাদের এবং আমাদের প্রিয়জনের জীবনে শান্তি ও সুখ বয়ে আনবে।
প্রায়োগিক পরামর্শ
- নিঃস্বার্থ হোন: আপনার প্রিয়জনের মঙ্গলকে নিজের স্বার্থের উপরে রাখুন।
- সমত্ব বজায় রাখুন: সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি সমানভাবে গ্রহণ করতে শিখুন।
- আত্মনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করুন: আপনার ইন্দ্রিয় ও মন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- জ্ঞান অর্জন করুন: সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে সচেষ্ট হোন।
- স্বাধীনতা দিন: আপনার প্রিয়জনকে তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য সমর্থন করুন এবং তাদের স্বাধীনতা সম্মান করুন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে প্রয়োগ করে আমরা সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ পেতে পারি এবং আসক্তির বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।