১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ১০

১ম অধ্যায়: অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক: ১০

শ্লোক ১০: অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্  

অর্থ ও ব্যাখ্যা: কুরুকুলের শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস

প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হল ধর্ম, কর্ম এবং জীবনের গভীর দিকনির্দেশনার অসাধারণ মিশ্রণ। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা শ্লোকগুলোতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যুদ্ধরত দুই শক্তিশালী পক্ষের মধ্যে কেমন অবস্থা বিরাজমান ছিল, তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে কথোপকথনে আমরা শুধু তত্ত্বজ্ঞান পাই না, বরং দৈনিক জীবনে প্রয়োগযোগ্য নীতিগুলি বুঝতে পারি।

শ্লোকটি এখানে মহাভারতের দুটি বৃহৎ বাহিনীকে নির্দেশ করে। এই শ্লোকে দুর্যোধনের মনোভাব এবং উভয় পক্ষের নেতৃত্বের ওপর তার আস্থা প্রকাশ পায়।  

 শ্লোকটির অর্থ  

এই শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়  “আমাদের সৈন্যবাহিনী যা ভীষ্মের দ্বারা সুরক্ষিত, তা অপর্যাপ্ত নয়; আর পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনী যা ভীমের দ্বারা সুরক্ষিত, তা যথেষ্ট।” এই শ্লোকের মূল দুটি শব্দ হল ‘অপর্যাপ্ত’ এবং ‘পর্যাপ্ত’।

 অপর্যাপ্ত বলতে বোঝানো হয়েছে অসীম, দুর্বল নয় এমন একটি শক্তিকে।

 পর্যাপ্ত বলতে বোঝানো হয়েছে সুসংগঠিত, পর্যাপ্ত কিংবা শক্তিশালী। 

 দুর্যোধনের অভিমত ও ভীষ্ম ও ভীমের ভূমিকা  

দুর্যোধন এই শ্লোকটি যখন বলছিলেন, তখন তার বিশ্বাস ছিল যে কৌরবদের শক্তি পাণ্ডবদের তুলনায় অধিক। তার কাছে ভীষ্ম পিতামহের উপস্থিতি ছিল একটি অসীম শক্তির প্রতীক, যিনি তার পুরো বাহিনীকে সুরক্ষিত রাখবেন। অন্যদিকে, তিনি অনুভব করেছিলেন যে পাণ্ডবদের জন্য ভীম একমাত্র ভরসা।  

এই শ্লোকটি মূলত একটি মানসিক অবস্থা প্রকাশ করছে, যেখানে দুর্যোধন তার বাহিনীর শক্তির ওপর আস্থা রাখছেন, কিন্তু মনে মনে কিছুটা দ্বিধাও রয়েছে। 

 পাণ্ডব ও কৌরবদের তুলনা  দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা  

মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দুই পরিবার, কৌরব ও পাণ্ডবের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাদের শক্তির পার্থক্য বোঝার জন্য কিছু প্রধান পয়েন্ট নিচে উল্লেখ করা হলো:

 কৌরবদের শক্তি  

   কৌরবদের বাহিনী অত্যন্ত বিশাল।

   ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং অশ্বত্থামার মতো মহান যোদ্ধারা তাদের পক্ষের নেতৃত্ব দেন।

   দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য এমন অনেক যোদ্ধা ছিল যারা সেরা সামরিক দক্ষতার অধিকারী। 

 পাণ্ডবদের শক্তি  

   পাণ্ডবদের পক্ষের মূল শক্তি ছিল ভীম, অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণের কৌশল। 

   তাদের পক্ষের সৈন্যসংখ্যা কৌরবদের তুলনায় কম হলেও তাদের প্রতিটি যোদ্ধার ওপর প্রগাঢ় আস্থা ছিল।

   শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি পাণ্ডবদের একটি বিশেষ শক্তি প্রদান করেছিল, যা শাস্ত্র ও শাস্ত্রজ্ঞানে উন্নত।

 ভীষ্ম পিতামহের ত্যাগ ও আস্থা  

এই শ্লোকে ভীষ্ম পিতামহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ তিনি ছিলেন কৌরবদের শক্তির প্রধান ভিত্তি। যুদ্ধে ভীষ্ম ছিলেন দুর্যোধনের সবচেয়ে বড় আস্থা এবং সমস্ত সৈন্যের জন্য প্রেরণার উৎস। তবে ভীষ্ম ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং তার মধ্যে ছিল এক নৈতিক দ্বিধা; পাণ্ডবদের জন্য তার ভালোবাসা সত্ত্বেও তিনি কৌরবদের হয়ে লড়াই করছিলেন।

 ভীম: পাণ্ডবদের শক্তির প্রতীক  

অন্যদিকে, ভীম ছিলেন সাহস ও বলের মূর্তি। পাণ্ডবদের বাহিনীর সাহসিকতার অন্যতম প্রতীক ছিলেন তিনি। তার চরিত্রে আমরা দেখতে পাই শক্তি এবং কৌশলের মিশ্রণ, যা কেবল শারীরিক নয় বরং মানসিক শক্তিও। 

 কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুর্যোধনের মানসিক অবস্থা  

শ্লোকটিতে দুর্যোধনের মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে। তার কাছে তার বাহিনী অপর্যাপ্ত মনে হচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, পাণ্ডবদের সঙ্গে লড়াই করাটা সহজ হবে না। দুর্যোধনের আত্মবিশ্বাস ও তার বাহিনীর ওপর আস্থা থাকা সত্ত্বেও, তার মনে কিছুটা দ্বিধা কাজ করছিল। 

 গীতা থেকে নেওয়া জীবনের শিক্ষণীয় পাঠ  

গীতার এই শ্লোকটি আমাদের শিখায় যে বাহ্যিক শক্তি এবং সংখ্যা জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সবসময় যথেষ্ট নয়। মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাসই প্রকৃত শক্তির উৎস হতে পারে।  

 গীতার শিক্ষাগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার উপায়  

আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষাগুলি অত্যন্ত কার্যকরী। এই শ্লোকটি থেকে আমরা যেসব জ্ঞান গ্রহণ করতে পারি:

 আত্মবিশ্বাস ও সাহস  

   আমাদের কোনো কাজের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।

   মনে সাহস রাখলে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগোলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ সহজে অতিক্রম করা যায়।

 সঠিক নেতৃত্বের গুরুত্ব  

   একজন ভাল নেতৃত্ব পুরো দলকে একত্রিত ও উৎসাহিত রাখতে সাহায্য করে।

 ধর্ম ও কর্তব্যের সমন্বয়  

   ধর্ম আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক পরিচালিত করতে সাহায্য করে।

 মহাভারতের শিক্ষা: আধুনিক যুগের জন্য  

আজকের যুগে মহাভারতের শিক্ষাগুলি আমাদের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ব্যবসা, সম্পর্ক, বা কোনো সামাজিক পরিস্থিতিতে আমরা প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। 

এই শ্লোকটি আমাদের শিখায় যে বাহ্যিক শক্তি যতো বড়োই হোক, অভ্যন্তরীণ আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিকতার সঙ্গে তার তুলনা হয় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top