১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ১১

১ম অধ্যায়: অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক: ১১

শ্লোক:  

অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।  

ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্ত্ত ভবন্তঃ সর্ব এব হি ॥১১॥

মহাভারতের শ্লোকটি ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমে এর মর্ম বোঝা দরকার। এখানে, দ্রোণাচার্য যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছেন কিভাবে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা যায়। এই বিশেষ শ্লোকে তিনি কৌরবদের জানাচ্ছেন, “যুদ্ধের অয়নগুলিতে সঠিকভাবে অবস্থান নাও এবং ভীষ্মকে রক্ষা করো। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান।”

 কেন ভীষ্মকে রক্ষা করা দরকার?

ভীষ্ম ছিলেন কৌরবদের প্রধান শক্তি, তাঁর অভিজ্ঞতা, সাহস এবং প্রজ্ঞা কৌরবদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভীষ্ম দেবব্রত ছিলেন শপথবদ্ধ, যিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কৌরবদের রক্ষা করতে। তাই দ্রোণাচার্য সবাইকে ভীষ্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন, কারণ তাঁর উপস্থিতি কৌরবদের আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করে তুলেছিল।  

 এই শ্লোকের তাৎপর্য ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা

এই শ্লোকটি কেবলমাত্র যুদ্ধ কৌশল নিয়ে নয়; এটি ধর্ম ও কর্তব্যবোধের গভীর বার্তা বহন করে। এই নির্দেশনার মাধ্যমে দ্রোণাচার্য একদিকে যুদ্ধের নিয়ম ও কৌশল অনুসরণ করার কথা বলছেন, অন্যদিকে ধর্মীয়ভাবে আমাদের জীবনের গুরুজনদের প্রতি কর্তব্য, ভক্তি ও দায়িত্ববোধের গুরুত্বও নির্দেশিত হচ্ছে।

 ভীষ্ম পিতামহের চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক

ভীষ্ম মহাভারতে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। তাঁর চরিত্রটি স্বার্থত্যাগ, কর্তব্য, সাহস ও ভক্তির প্রতীক। তিনি ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী ছিলেন এবং নিজ ইচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করা। তিনি শুধুমাত্র এক যোদ্ধা ছিলেন না, বরং এক আদর্শ পিতামহ ও অভিভাবক ছিলেন।

 ভীষ্মের শিক্ষা ও দর্শন:

 স্বার্থত্যাগ: ভীষ্ম তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেছেন নিজের সুখ ও স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে।

 ধর্ম ও কর্তব্যবোধ: ধর্মানুরাগী হিসেবে ভীষ্ম সঠিক পথে চলার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন এবং সর্বদা নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন।

 বিনয় ও ভক্তি: গুরুজন ও পিতৃপুরুষদের প্রতি ভক্তি ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

 ভীষ্ম পিতামহের ধর্মকর্তব্য পালন ও এর প্রভাব

এই শ্লোকের মাধ্যমে এক নতুন আঙ্গিকে ভীষ্ম পিতামহের কর্তব্যপরায়ণতা ও ধর্মীয় ভক্তির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। একজন সত্যিকার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসাবে ভীষ্ম সর্বদাই নিজের কর্তব্য পালনে নিবেদিত ছিলেন। এটি আমাদের শেখায় যে ধর্মানুষ্ঠানের পথে থেকে নিজের কাজ করে যাওয়া সঠিক।  

 ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শেখার বিষয়:

 গুরুজন ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা।

 কর্তব্যে অবিচল থাকা, যে কোনো পরিস্থিতিতেই নিজের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা।

 আত্মত্যাগ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ।

 ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যকার সংলাপ ও তার গুরুত্ব

ভীষ্মের জীবন ও তাঁর শিক্ষাগুলো পাণ্ডবদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। একবার যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, “পিতামহ, কীভাবে আমরা ন্যায়ের পথে থাকতে পারি?” ভীষ্ম উত্তরে বলেছিলেন, “ধর্মের পথে চলা সহজ নয়, কিন্তু সঠিক পথ সেটাই। আমাদের জীবনে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আমরা নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করবেই, এবং সেটাই ধর্ম।”

 পাঠকের জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক শিক্ষণীয় দিক

 গুরুজনের প্রতি সম্মান: আমাদের জীবনের গুরুজনদের পরামর্শ ও দায়িত্ব আমাদের কর্তব্য।

 ধর্ম ও কর্তব্যপালন: যে কোনো পরিস্থিতিতে ধর্ম মেনে চলা এবং নীতিকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা।

 ভীষ্ম পিতামহ থেকে শিক্ষার আবেদন

মহাভারতের এই শ্লোকের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুরুজন ও অভিভাবকদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের পরামর্শে চলা এবং তাঁদের নিরাপত্তা ও কল্যাণে নিবেদিত থাকার গুরুত্ব আমাদের শেখায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top