ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ মহাভারত আমাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক জ্ঞানভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। মহাভারতের যুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত একএকটি ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রতিটি শ্লোকের আড়ালে রয়েছে গভীর বার্তা। আজকের ব্লগে আমরা মহাভারতের শ্লোক ১২ আলোচনা করব, যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রথম পর্বের একটি উদাহরণ এবং শ্রীভীষ্মের যুদ্ধের আহ্বান ঘোষণা হিসেবে পরিচিত।
শ্লোকটি ও এর অর্থ
“তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ॥১২॥”
বাংলায় অর্থ করলে, এর মর্মার্থ দাঁড়ায় – “যুদ্ধে আনন্দ আনয়ন করে, কুরুদের প্রাচীন পিতামহ প্রতাপশালী ভীষ্ম সিংহনাদ করে জোরে শঙ্খধ্বনি করলেন।” এই শ্লোকটি মূলত মহাভারতের যুদ্ধের সূচনা মুহূর্তকে নির্দেশ করে, যেখানে ভীষ্মের শঙ্খধ্বনি মহাকাব্যের যুদ্ধের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভীষ্মের চরিত্র ও তাঁর ভূমিকা
ভীষ্ম মহাভারতের এক অসাধারণ চরিত্র, যাঁকে আমরা ‘কুরুবংশের পিতামহ’ হিসেবে জানি। তাঁর প্রতাপ ও সাহস তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। শ্রীভীষ্ম মহাভারতে একাধারে দক্ষ যোদ্ধা এবং নিষ্ঠাবান পিতামহ, যাঁর আদর্শ ও নীতি অন্যকে সহজেই অনুপ্রাণিত করে। ভীষ্মের জীবন ও তাঁর যুদ্ধনীতি বুঝতে পারলে মহাভারতের অনেক রহস্যই স্পষ্ট হয়।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আবহ এবং শঙ্খধ্বনির তাৎপর্য
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ছিল ধর্মের জন্য এক মহাযুদ্ধ। ভীষ্মের শঙ্খধ্বনি কেবল যুদ্ধের সূচনা করে না, এটি কৌরব সেনাবাহিনীতে সাহস ও আত্মবিশ্বাস আনয়ন করে। ভীষ্মের শঙ্খধ্বনির এই মুহূর্তকে যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে ধরা যায়, যা কৌরবদের জন্য এক উদ্দীপনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সিংহনাদ: ভীষ্ম যখন শঙ্খধ্বনি করেন, তখন এটি সিংহের মতো গর্জনের মতো শোনা যায়। এটি প্রতিপক্ষের মনে ভয় ও কৌরবদের মনে সাহস এনে দেয়।
উচ্চৈঃ শব্দটি: এর মানে উচ্চ বা জোরালো ধ্বনি। শঙ্খধ্বনি দিয়ে তিনি যোদ্ধাদের জানিয়ে দেন যে যুদ্ধের আরম্ভ হতে যাচ্ছে এবং এটি ধর্মের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম।
ভীষ্মের শঙ্খধ্বনির সঙ্গে সংযুক্ত একটি পৌরাণিক কাহিনী
এই শঙ্খধ্বনির কথা যখন আমরা পড়ি, তখন আমাদের মনে পড়ে আরও একটি পুরাণ কাহিনী, যেখানে শঙ্খের ধ্বনির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একবার দেবরাজ ইন্দ্র দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার পূর্বে নিজের শঙ্খ ধ্বনিত করে যুদ্ধের ডাক দেন। সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে দানবদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয় এবং তারাও জানতে পারে যে শক্তিশালী ইন্দ্র তাদের বিরুদ্ধে আসছে।
ভীষ্মের এই যুদ্ধ শুরুতে ধর্মের মর্মবাণী
মহাভারত শুধুমাত্র যুদ্ধের গল্প নয়; এটি আমাদের ধর্ম, নীতি ও কৃতজ্ঞতার এক মূর্ত প্রতীক। ভীষ্মের শঙ্খধ্বনি, যে ধ্বনিতে যুদ্ধের আহ্বান ছিল, সেটি কেবল শারীরিক যুদ্ধের জন্য নয় বরং আমাদের জীবন সংগ্রামের জন্যও এক উদাহরণ।
ধর্ম ও দায়িত্ব: ভীষ্ম এই শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে আমাদের শেখাচ্ছেন যে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আমাদের ধর্ম, অর্থাৎ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগ: তিনি কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন শুধুমাত্র তাঁর প্রতিশ্রুতির জন্য। আমাদেরও শিখতে হবে নিজের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকা।
ভীষ্মের শঙ্খধ্বনির সঙ্গে আমাদের জীবনের সংযোগ
ভীষ্মের শঙ্খধ্বনি আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সংগ্রামের প্রতীক। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হই। প্রতিটি চ্যালেঞ্জে আমাদের মনে রাখা উচিত যে প্রতিটি বাধা জয় করার আগে সাহসের শঙ্খধ্বনি করতে হয়।
কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষা:
সাহস: ভয়কে পরাভূত করতে সাহসের প্রয়োজন।
আত্মনিয়ন্ত্রণ: নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা।
প্রতিজ্ঞা পালন: ভীষ্মের মতো নিজের দায়িত্ব ও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাই জীবনের মূলমন্ত্র।
ধর্মের পথে সত্য ও সাহসের প্রতীক ভীষ্ম
ভীষ্মের শঙ্খধ্বনি আমাদের জীবনে এক অন্তর্নিহিত বার্তা দেয় – সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে আমাদের সাহস ও নিষ্ঠার প্রয়োজন। মহাভারতের শ্লোক ১২ এর মধ্য দিয়ে শ্রীভীষ্ম কেবল যুদ্ধে আহ্বান জানাননি, তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে সাহসী হতে শিখিয়েছেন।
ভীষ্মের এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্যের পথে অবিচল থাকতে হবে, যেভাবে ভীষ্ম তাঁর নিজ ধর্ম ও প্রতিজ্ঞার প্রতি অবিচল ছিলেন।