১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ১৩

১ম অধ্যায়: অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক: ১৩

মহাভারতের যুদ্ধের সময় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রহস্যে, উন্মাদনায়, এবং এক ভয়ানক শক্তির সাক্ষী। শ্লোক ১৩ থেকে সেই সময়ের এক বিশেষ মুহূর্ত ফুটে ওঠে যেখানে শঙ্খধ্বনি ও যুদ্ধবাদ্যর আওয়াজ সমস্ত পরিবেশকে পূর্ণ করেছিল। চলুন, এই শ্লোকের মাধ্যমে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে আমরা আরও গভীরভাবে অনুধাবন করি।

 শ্লোকটি বিশ্লেষণ: শব্দের অর্থ ও অনুভূতি

ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ। সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোভবৎ ॥

এই শ্লোকটি গীতার প্রথম অধ্যায়ের একটি অংশ, যেখানে যুদ্ধের প্রাক্কালে রণভূমির বিশাল উন্মাদনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। একদিকে ছিল পাণ্ডবদের সেনা, আর অন্যদিকে কৌরবদের শক্তিশালী বাহিনী। যুদ্ধ শুরুর আগে সন্নিধানে শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, এবং গোমুখের ধ্বনি মুখরিত হয়েছিল।

 যুদ্ধের প্রাকমুহূর্তে আওয়াজের অর্থ

শ্লোকে বলা হচ্ছে যে এই সমস্ত শঙ্খধ্বনি এবং রণবাদ্যের আওয়াজ একসঙ্গে মিলিত হয়ে এমন এক প্রবল রণউন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল যে সেখানে উপস্থিত প্রত্যেক সৈন্যের হৃদয় ভরে উঠেছিল যুদ্ধের জন্য উন্মুখ এক ভয়ঙ্কর জাগ্রত শক্তিতে। রণবাদ্যগুলোর আওয়াজে রণাঙ্গনের পরিবেশ যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল, আর সেই প্রবল শব্দের মাধ্যমে সবাই বুঝতে পারছিল যে এক মহাযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।

 যুদ্ধের আগে বাজানো শঙ্খের তাৎপর্য

শঙ্খ বা শঙ্খধ্বনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে পবিত্র এবং শক্তির প্রতীক। প্রাচীন যুগে শঙ্খধ্বনি ছিল যুদ্ধের আহ্বান এবং যোদ্ধাদের জাগ্রত করার প্রতীক। মহাভারতের যুদ্ধে প্রতিটি যোদ্ধা নিজ নিজ শঙ্খ বাজিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তারা তাদের সাহস ও সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন। যেমন:

 পাণ্ডবদের শঙ্খ: ভীমের পাউণ্ড্র, অর্জুনের দেবদত্ত, যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয়।

 কৌরবদের শঙ্খ: কৌরব পক্ষের শঙ্খধ্বনি রাজা দুর্যোধন ও তার সৈন্যদের শক্তি ও সাহস প্রকাশ করেছিল।

 যুদ্ধের প্রাক্কালে রণবাদ্যর ঐতিহ্য

ভারতীয় সংস্কৃতিতে রণবাদ্যগুলির বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। মহাভারতের যুদ্ধে আমরা রণবাদ্যের ব্যবহার দেখি। এই রণবাদ্য বা যুদ্ধ বাদ্য বাজানো হত যুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের উজ্জীবিত করার জন্য। রণবাদ্যগুলির কিছু উদাহরণ হলো:

  •  ভেরী: এটি এক ধরনের ড্রাম, যা খুব জোরে আওয়াজ করে এবং সৈন্যদের রণোন্মাদনা বাড়ায়।
  •  পণব: ছোট ড্রাম যা শত্রুদের বিভ্রান্ত করার জন্য বাজানো হয়।
  •  আনক: এটি কিছুটা মৃদু ধরনের ড্রাম, যা যুদ্ধের শান্ত মুহূর্তেও বাজানো হয়।

 কাহিনীর অন্তর্নিহিত অর্থ: কুরুক্ষেত্রের শুরু

মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ একটি পৌরাণিক ও ধর্মীয় যজ্ঞ, যেখানে সৎ ও অসৎ, ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শঙ্খ ও রণবাদ্যগুলোর আওয়াজ সৈন্যদের হৃদয়ে অমিত সাহস সঞ্চার করেছিল এবং তাদের সন্নিধানে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল। এই শ্লোকটি রণাঙ্গনের সেই মহৎ মুহূর্তটিকে তুলে ধরে যেখানে সমস্ত বাহিনী এবং দেবতারা যুদ্ধের জন্য উৎসুক ছিলেন।

 মহাভারতের সেই ঐতিহাসিক গল্প: অর্জুন ও কৃষ্ণের মুহূর্ত

যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে, অর্জুন তার সারথি কৃষ্ণের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। অর্জুন তখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন তার নিজ পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। এই রণাঙ্গনের তুমুল আওয়াজ এবং সেই সন্নিধানে কৃষ্ণ তার নিজের বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে অর্জুনকে বোঝালেন যে ধর্মের পথে যুদ্ধ করতে গেলে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির এই আওয়াজ অর্জুনকে তার দ্বিধা কাটিয়ে যুদ্ধে প্রবেশ করার প্রেরণা দিয়েছিল।

 রণশঙ্খ ও রণবাদ্য: দেবতা এবং মানুষের যুগল ঐতিহ্য

ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়, যখন দেবতারা অসুরদের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতেন, তখনও এই রণবাদ্য ও শঙ্খধ্বনি বাজানো হত। শাস্ত্রে বিভিন্ন দেবতা যেমন বিষ্ণু, ইন্দ্র এবং দুর্গার রণবাদ্যর উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবতাদের জন্য শঙ্খ ও রণবাদ্যের ধ্বনি একটি শক্তিসঞ্চারের প্রতীক, যা তাদের আত্মার গভীরে সাহস ও উদ্যম এনে দিত। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রেও এই ঐতিহ্য দেখা যায়।

 কেন রণবাদ্য এত গুরুত্বপূর্ণ?

প্রাচীন ভারতে মনে করা হত যে রণবাদ্য সৈন্যদের মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি এবং সাহস এনে দেয়, যা তাদের ভয় দূর করে এবং যুদ্ধের জন্য তাদের মনকে প্রস্তুত করে। রণবাদ্যের প্রভাব ছিল:

 সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি

 শত্রুদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার

 যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করা

 ধর্মের পথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার প্রেরণা

 শঙ্খধ্বনির আধ্যাত্মিক দিক

শঙ্খধ্বনি শুধু রণাঙ্গনের আহ্বান নয়, এটি এক ধরণের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ। শঙ্খধ্বনি ধ্বনির মাধ্যমে পবিত্রতা এবং শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে শঙ্খধ্বনি মঙ্গলজনক বলে মনে করা হয়। রণাঙ্গনের এই শঙ্খধ্বনির মাধ্যমেও যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রতিফলন সৃষ্টি হয়েছিল। 

আমাদের শিক্ষা

এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে যখন কোনো মহৎ কার্যে প্রবৃত্ত হওয়ার সময় আসে, তখন সমস্ত দ্বিধা ও ভয়কে দূরে সরিয়ে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যেমন অর্জুন তার শঙ্খ বাজিয়ে তার সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন, আমাদেরও দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি কর্মে পূর্ণ উত্সর্গ এবং সাহস নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত।

মহাভারতের এই ঐতিহাসিক শ্লোক এবং রণাঙ্গনের শঙ্খধ্বনি আমাদের জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত হতে অনুপ্রাণিত করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top