শ্লোক
“দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে ।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্ ॥” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১:১৮)
এই শ্লোকে, অর্জুন ও কৃষ্ণের পাশে তাদের নিজ নিজ সেনাদল যে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত, তার উদ্দীপ্ত মূহুর্তকে চিত্রিত করা হয়েছে। দ্রুপদ, দ্রৌপদেয়, এবং মহাবাহু সৌভদ্র (অভিমন্যু) এই মহাযুদ্ধে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি ঘোষণা করছেন। এই শঙ্খধ্বনির অর্থ এখানে শুধু যুদ্ধের সূচনা নয়; এটি যোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস এবং ভগবানের আশীর্বাদে তাদের অনুপ্রাণিত হওয়ার প্রতীক।
শঙ্খধ্বনির গুরুত্ব: এক ঐতিহ্যবাহী শক্তি প্রকাশ
শঙ্খধ্বনি:
শঙ্খ, প্রাচীন হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মন্দিরে পূজার সময় শঙ্খ বাজানোর রীতি রয়েছে, যা দুষ্ট শক্তিকে বিতাড়িত করতে এবং দেবদেবীর কাছে ভক্তি নিবেদন করতে ব্যবহৃত হয়। মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটি যোদ্ধার শঙ্খধ্বনি এক অনন্য শক্তির প্রকাশ। এখানে দ্রুপদ ও তাঁর পাঁচ পুত্র এবং অভিমন্যু যে শঙ্খধ্বনি করেন, তা তাঁদের সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং ভক্তির এক অপরূপ উদাহরণ।
দ্রুপদের ভূমিকা ও শক্তির পরিচয়
দ্রুপদ: দ্রৌপদীর পিতা এবং পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা। দ্রুপদ যেমন একজন সামর্থ্যবান যোদ্ধা, তেমনই তাঁর মধ্যে যুদ্ধের প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধা ছিল। দ্রুপদ মহাভারত যুগে তার আভিজাত্য এবং শক্তির জন্য খ্যাত ছিলেন। শঙ্খধ্বনি তাঁর জন্য এক সম্মানের প্রতীক, যা তাকে ভগবান কৃষ্ণের প্রতি তাঁর অনুগত অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দ্রৌপদেয়দের শঙ্খধ্বনি: উত্তরাধিকারের প্রকাশ
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, যাদের বলা হয় দ্রৌপদেয়। এই পুত্রেরা প্রত্যেকে একজন মহাবীর যোদ্ধা। তাঁদের শঙ্খধ্বনি তাঁদের পিতামাতার প্রতিশ্রুতি এবং পাণ্ডবদের প্রতি তাঁদের অন্তর্নিহিত সেবার প্রতীক। পঞ্চপাণ্ডবের উত্তরসূরী হিসাবে, দ্রৌপদেয়রা তাদের পিতামাতার দায়িত্ব ও ধর্ম পালন করেই নিজেদের শক্তি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
দ্রৌপদেয়দের উৎসাহ
উৎকৃষ্ট পিতৃঋণ: যুদ্ধে যোগদানের মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারকে গৌরবান্বিত করে।
নির্ভীক যোদ্ধা: তাঁদের সাহস ও মনোবল যা শঙ্খধ্বনিতে প্রকাশ পেয়েছে, পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে এক অনন্য উজ্জীবন সৃষ্টি করেছে।
সৌভদ্র: এক সাহসী উত্তরসূরী
অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু, যাকে মহাবাহু সৌভদ্র বলা হয়েছে। অভিমন্যু তাঁর শৈশব থেকে তাঁর পিতার মতো যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষিত এবং বীরত্বে অনন্য। তাঁর শঙ্খধ্বনি ছিল তাঁর সাহসিকতা এবং কৌরবদের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের প্রতীক।
অভিমন্যুর বীরত্ব:
অভিমন্যুর জীবন গল্পটি হিন্দু ধর্মে অমর। তিনি চক্রব্যূহে প্রবেশ করে বিপুল শত্রু সেনার বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করেন। এ ছিল তাঁর সাহস এবং যুদ্ধজ্ঞান। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি জীবন বিসর্জন দেন, তবুও অভিমন্যুর এই আত্মত্যাগ তাকে অমর করে রেখেছে।
কেন শ্লোকটি আজও প্রাসঙ্গিক?
এই শ্লোকটি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে অনুপ্রাণিত করতে পারে। শঙ্খধ্বনির অর্থ দাঁড়ায় আমাদের ভেতরের শক্তির প্রকাশ।
জীবনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা:
আত্মবিশ্বাস: প্রতিটি কাজে শঙ্খধ্বনির মতো আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত।
অটল নিষ্ঠা: যেভাবে দ্রুপদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ধর্ম পালন করে গেছেন, আমাদেরও জীবনে আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে অটল থাকা উচিত।
শঙ্খধ্বনি ও আমাদের জীবনের প্রয়োগ
এই শ্লোকটি শুধু ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও শঙ্খধ্বনির মতো শক্তি ও সাহস প্রকাশের শিক্ষা দেয়।