শ্লোকটি:
“অথ ব্যবস্তিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডবঃ
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে ॥২০॥”
বাংলা অনুবাদ:
তখন, কপিধ্বজ অর্জুন যখন কৌরবদের যুদ্ধে প্রস্তুত অবস্থায় দেখলেন, এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় চলে এসেছে, তখন তিনি ধনুকে তুলে নিয়ে হৃষীকেশকে (শ্রীকৃষ্ণকে) বললেন, “হে মহীপতি, আমার মনে আজ এক দ্বিধার জন্ম হয়েছে।”
শ্লোকের পটভূমি: দ্বিধার আবর্তে অর্জুন
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে এই শ্লোকটি আসে, যেখানে অর্জুন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে তার আত্মীয়, বন্ধু, এবং শিক্ষকগণকে দেখতে পান। যুদ্ধে অস্ত্র ধরা অর্জুনের মনে তখন দ্বিধা ও সংকট তৈরি হয়—একদিকে ধর্মের আহ্বান, অন্যদিকে আত্মীয়বিয়োগের যন্ত্রণা। অর্জুন, যিনি শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং প্রতিভাধর যোদ্ধা, শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে সাহায্যের আবেদন করেন।
কেন এই শ্লোক গুরুত্বপূর্ণ?
- ধর্মের সঠিক উপলব্ধি: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ প্রতিটি হিন্দুর কাছে ধর্ম এবং কর্তব্যের অর্থ বোঝার একটি প্রয়োজনীয় পর্ব। অর্জুনের দ্বিধা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কখনও কখনও ধর্মের পথে চলতে গিয়ে আমাদের হৃদয়কে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
- আত্মসংকট এবং উপদেশ: এই শ্লোকটি ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখার মাধ্যমে কিভাবে সংকটকে দূর করা যায়, সেই শিক্ষাও দেয়।
হৃষীকেশ: কৃষ্ণের এক বিশেষ রূপ
এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণকে “হৃষীকেশ” নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার অর্থ “ইন্দ্রিয়ের অধিপতি”। শ্রীকৃষ্ণ এখানে কেবল অর্জুনের মনকে শান্ত করতেই আসেননি, তিনি অর্জুনের ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে এসেছেন।
একটি পুরাণের কাহিনী: কৃষ্ণের ধৈর্যশিক্ষা
এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর কাহিনী মনে আসে। একবার কৃষ্ণ একটি বনে ঘুরছিলেন। একদিন বনের মধ্যে এক শিকারি একটি আহত পাখির দিকে তীর তাক করে শিকার করার চেষ্টা করছিলেন। তখন পাখিটি ভয়ে কৃষ্ণের পাশে এসে আশ্রয় নেয়। কৃষ্ণ ধৈর্য ধরে পাখিটিকে রক্ষা করেন এবং শিকারিকে বোঝান যে, প্রত্যেক প্রাণীরই নিজস্ব অস্তিত্বের অধিকার আছে। এই ঘটনায় কৃষ্ণ দেখিয়েছিলেন, কিভাবে কেবল শত্রুর প্রতি ক্ষোভ না রেখে, সঠিক উপলব্ধির দ্বারা পরম করুণা লাভ করা যায়। অর্জুনের ক্ষেত্রেও কৃষ্ণ তাঁর ধৈর্য ও সহানুভূতির মাধ্যমে অর্জুনকে সঠিক পথ দেখাতে আগমন করেছিলেন।
অর্জুনের মনোভাবের বিশ্লেষণ
- বিরোধী মানসিকতা: অর্জুনকে যুদ্ধের সময় দ্বিধাগ্রস্থ হতে দেখা যায়, যা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের একটি সাধারণ দিক। আমাদের সকলের মধ্যেই অর্জুনের মতো দ্বিধা থাকে, বিশেষত যখন আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
- ধর্ম ও কর্তব্য: অর্জুনের অবস্থান এই শিক্ষাটিকে শক্তিশালী করে তোলে যে, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই প্রকৃত ধর্মের রূপ।
কৃষ্ণের বার্তা: “ধর্ম পালনে দ্বিধা নয়”
কৃষ্ণ অর্জুনকে জানান যে, যে দ্বিধা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে, সেই দ্বিধা আসলে মায়ার ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। তিনি অর্জুনকে বোঝান যে, প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে তাঁর কর্তব্য হচ্ছে সত্য ও ধর্মের পক্ষে লড়াই করা। অর্জুনের মত সকলেই নিজেদের জীবনে কখনও না কখনও দ্বিধায় পড়ে, তবে সেই দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণের মত একজন গাইডের প্রয়োজন।
এই শ্লোকের মাধ্যমে যা শেখা যায়
- অন্তরের দৃঢ়তা: দ্বিধা কাটিয়ে দৃঢ় মনোভাব গড়ে তোলাই জীবনের মূল শিক্ষা।
- ধর্মের প্রতি অটল বিশ্বাস: নিজের ধর্ম এবং কর্তব্য সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের উচিত মনের সব ধরনের ভয় এবং বিভ্রান্তি দূর করা।
কেন এই বার্তা এখনো প্রাসঙ্গিক?
আজকের সময়েও এই শ্লোকটি আমাদের জীবনে বহু দ্বিধা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাসে উন্নীত করতে সাহায্য করে। বহু ক্ষেত্রে আমরা অর্জুনের মতো সংকটে পড়ি, যেখানে ধর্ম এবং কর্তব্যের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ এবং হিন্দু ধর্মের মূল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
অর্জুন ও আমাদের জীবনের দ্বিধা
“অথ ব্যবস্তিতান্ দৃষ্ট্বা”— এই বাক্যাংশের মধ্যেই সমস্ত সংকটের উন্মোচন। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনে চলার পথে নির্ভয়ে, ধর্মমতে নিজের কাজ সম্পন্ন করা উচিত।