১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ২৩

১ম অধ্যায়: অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক: ২৩

“যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।  

ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ ॥২৩॥”

 অনুবাদ:

“আমি (অর্জুন) দেখতে চাই, এখানে এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে যারা সমবেত হয়েছে এবং যাদের উদ্দেশ্য দুর্বুদ্ধি ধার্তরাষ্ট্রদের (কৌরবদের) মঙ্গল সাধন করা।”

গীতার প্রথম অধ্যায়ে, মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে এবং অর্জুন প্রস্তুত হচ্ছেন যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়াতে। কিন্তু তিনি যুদ্ধের পূর্বেই এক বিরাট মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পতিত হন, যা তাকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে।

 অর্জুনের দ্বিধা এবং যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক সংকট

অর্জুন এই শ্লোকে শত্রুপক্ষের দিকে তাকিয়ে তাদের ‘দুর্বুদ্ধি’ বা দুর্বুদ্ধি বলে অভিহিত করেছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি সরাসরি কৌরবদের মধ্যে বিদ্যমান অসাধু মানসিকতার প্রতি ক্ষুব্ধ, কিন্তু এই অনুভূতি অর্জুনের মনে এক বিশাল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। এই দ্বন্দ্ব শুধু যুদ্ধের নয়, বরং ন্যায়অন্যায়, ধর্ম এবং সম্পর্কের জটিলতার গভীরতর উপলব্ধির প্রকাশ।

 অর্জুন কেন ‘দুর্বুদ্ধি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন?

  • অহংকার: কৌরবরা, বিশেষত দুর্যোধন, অহংকারে অন্ধ ছিল। মহাভারতে দেখা যায়, কৌরবদের কাছে আত্মগরিমা এবং শক্তি প্রদর্শন ছিল অনেক বড় বিষয়।
  • অন্যায় প্রবণতা: পাণ্ডবদের সাথে কৌরবদের বৈরী সম্পর্কের মূলেও এই অন্যায় প্রবণতা এবং পরনিন্দার প্রবলতা।
  • . ধর্মঅধর্ম বিচারহীনতা: কৌরবরা অনেকক্ষেত্রেই ন্যায়অন্যায়ের বিচার ছেড়ে শুধুমাত্র শক্তির ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিল।

 মহাভারতের একটি কাহিনী: যুদ্ধের আগের সন্ধিক্ষণ

যুদ্ধ শুরুর আগে, যখন দুই পক্ষই সৈন্যদের প্রস্তুত করে রেখেছিল, তখন অর্জুন তার চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন এই যুদ্ধের পরিণাম। পরিবারের সদস্য, গুরু, বন্ধু—সকলেই এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, যারা একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন একটি সময়ে, অর্জুন ভাবতে শুরু করেন যে আদৌ কি এই যুদ্ধ ন্যায়সংগত?

এখানে অর্জুনের মনে প্রশ্ন জাগে: “যারা আমাকে ভালোবাসে, এবং যাদের আমি ভালোবাসি, তাদের আমি কীভাবে হত্যা করতে পারি?” এই প্রশ্ন অর্জুনের শ্লোকে পরিষ্কার ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

 অর্জুনের মানবিকতা ও কৌরবদের দুর্বুদ্ধি: ধর্ম এবং আত্মা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব

গীতার এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করতে গেলে ধর্ম এবং আত্মার প্রশ্ন আসে সামনে। আমরা বুঝতে পারি যে অর্জুনের এই প্রশ্ন শুধুমাত্র যুদ্ধের নয়, বরং মানবিকতা, ধর্ম এবং ন্যায় বিচারের মূল প্রসঙ্গকে তুলে ধরে। 

 অর্জুনের দ্বিধার মূল কারণ:

 সম্পর্কের দ্বন্দ্ব: এই যুদ্ধ কেবল দুই সাম্রাজ্যের নয়; এখানে যুদ্ধ হচ্ছে দুই পরিবারের মধ্যে। এখানে অর্জুন শুধুমাত্র তার শত্রুর মুখোমুখি হচ্ছেন না, বরং তাদেরকেও হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন যাদের সাথে সম্পর্ক গভীর।

 ধর্ম বা কর্তব্য পালন: অর্জুন বুঝতে পারেন, তার ধর্ম বা কর্তব্য হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যদি সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে নিজ পরিবারের লোকেদের হত্যা করতে হয়, তাহলে তা কতটা ন্যায়সংগত?

 মৃত্যু ও ধর্মের সম্পর্ক: অর্জুন বিশ্বাস করেন যে, আত্মা অবিনশ্বর, তাই এই যুদ্ধ শুধুমাত্র শরীরের ক্ষতি করতে পারে, আত্মার নয়। কিন্তু মানবিক সম্পর্কের মানসিক দ্বন্দ্ব তাকে মর্মাহত করে তোলে।

 শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ: আত্মজ্ঞানের আহ্বান

অর্জুন যখন এইভাবে মানসিক সংকটে পড়েন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে আত্মার প্রকৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এই শ্লোকের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আত্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছিলেন।

 শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন:

 আত্মা অবিনশ্বর: আত্মা কোনো দিন নষ্ট হয় না। এই দেহ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা চিরন্তন।

 যুদ্ধ শুধুমাত্র এক দায়িত্ব: অর্জুন যদি তার দায়িত্ব পালন করতে চান তবে তাকে একগুঁয়ে হতে হবে এবং মানবিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ধর্মকে গ্রহণ করতে হবে।

 নৈতিকতার পুনঃস্থাপন: এই যুদ্ধ কেবল প্রতিশোধের নয়, বরং এই যুদ্ধ হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠার এবং সমাজে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য।

 গীতার শিক্ষা: অর্জুনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবনবোধ

এই শ্লোকটি আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও দেয়। অনেক সময় আমরা বিভিন্ন দ্বন্দ্ব এবং সম্পর্কের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ি এবং আমাদের মূল কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই।

 এই শ্লোকের শিক্ষাসমূহ:

 দায়িত্ব পালন: জীবনে অনেক সময় আমাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হলে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সম্পর্কের মায়াজাল থেকে বের হয়ে ন্যায় ও ধর্মের পক্ষে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

 মানসিক সংকট থেকে মুক্তি: অর্জুনের মত মানসিক সংকট আমাদের জীবনে অনেকবার আসে। এমন সময়ে আত্মার প্রকৃতি, সঠিক ধর্ম এবং উদ্দেশ্যকে স্মরণ করলে আমরা সঠিক পথ খুঁজে পেতে পারি।

 জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাস: গীতার এই শ্লোক আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে শেখায়। আত্মার প্রকৃতিকে বোঝা এবং জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের দায়িত্বে অবিচল থাকতে পারি।

 শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবন

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রতিটি শ্লোকই আমাদের জীবনের দিকনির্দেশনা দেয়। প্রতিটি মানুষের জীবনে কখনও না কখনও অর্জুনের মতই কোনো না কোনো প্রশ্ন বা সংকট দেখা দেয়, যখন তিনি বুঝতে পারেন না কোন পথে অগ্রসর হওয়া উচিত। এমন সময়ে, গীতার এই শিক্ষা আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top