১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ২৪

১.২৪ঃ শ্রীকৃষ্ণের “হৃষীকেশ” নামের তাৎপর্য?

“সঞ্জয় উবাচ: এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত, সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্ ॥২৪॥” 

গীতার ২৪তম শ্লোকটি ভগবদগীতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে প্রতিফলিত করে। এই শ্লোকে, অর্জুনের উদ্বেগ ও দ্বিধা দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে দুই পক্ষের সেনাবাহিনীর মাঝখানে স্থাপন করেন। গীতার প্রতিটি শ্লোকই আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এই বিশেষ শ্লোকটি আমাদের দ্বন্দ্ব ও সংকটের মুহূর্তে ভগবানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।

 শ্রীকৃষ্ণের “হৃষীকেশ” নামের তাৎপর্য 

শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে “হৃষীকেশ” বলা হয়েছে। “হৃষীকেশ” শব্দটির অর্থ “ইন্দ্রিয়গুলোর ঈশ্বর”। এই নামের মাধ্যমে ভগবান ইঙ্গিত করছেন যে, তিনি অর্জুনের মনের সব অনুভূতি, তার দুশ্চিন্তা, দ্বন্দ্ব সব কিছু জানেন। শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনের আস্থার স্থান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন।

 গুড়াকেশ: অর্জুনের শক্তি ও দ্বন্দ্ব 

এই শ্লোকে অর্জুনকে “গুড়াকেশ” বলা হয়েছে, যার অর্থ “যিনি ঘুমকে জয় করেছেন”। এই নাম অর্জুনের দৃঢ় সংকল্প ও অদম্য মানসিকতার প্রতীক। কিন্তু যুদ্ধের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, নিজের কুলপরিজনের মুখোমুখি হওয়ার ভয় এবং দ্বন্দ্ব তার মনে তীব্রভাবে উদ্ভাসিত হয়েছিল। 

 ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবস্থান: দুই সেনার মাঝে 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনের রথটি দুই পক্ষের সেনার মাঝখানে স্থাপন করেন। এই স্থাপনের মাধ্যমে ভগবান অর্জুনকে তার আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করার সুযোগ দেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন আমরা দ্বিধা ও বিভ্রান্তিতে পড়ি, তখন আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে শ্রীকৃষ্ণের মত ঈশ্বরও আমাদের কাছে আসেন।

 ধর্ম এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গল্প  

একবার ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য এবং কর্ণকে হত্যা করার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অর্জুন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন কিভাবে কৃত্তিবাস ও রামের মতো মহাপুরুষরা নিজেদের কর্তব্যকে সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানান যে, সত্যিকার ধর্ম ও কর্তব্য পালনের জন্য নিজেদের মনের সকল ভয় ও মোহকে জয় করতে হয়।

 শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা: আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি 

  •  ভগবানের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, কারণ তিনি সব জানেন।
  •  আমাদের দ্বন্দ্ব ও সংকটকে উপলব্ধি করার জন্য সময় দিন।
  •  আত্মজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আরও শক্তিশালী করুন। 
  •  জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ভগবানের উপস্থিতি অনুভব করুন।

 অর্জুনের দ্বিধা এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ 

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে থাকেন যে, জীবনে সফল হতে হলে অন্তরের ভয়কে জয় করতে হয়। এই উপদেশ কেবল অর্জুনের জন্য নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ঈশ্বর আমাদের সকল দ্বিধা ও সংকটে পাশে থাকেন।

 গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যা আমরা এই শ্লোক থেকে পাই:

  •  আস্থা ও বিশ্বাস: ভগবানের প্রতি বিশ্বাস আমাদের সংকটকালে স্থিরতা দেয়।
  •  অন্তরের শক্তি: দ্বিধা ও সংকটের সময় মনকে স্থির রাখা উচিত।
  •  কর্তব্য ও ধর্মের পথে চলা: ধর্মের পথে চলা সবসময় সহজ হয় না, কিন্তু সত্যের পথে থাকলে জয় আমাদের হবেই।

গীতার এই শ্লোক থেকে আমরা জানতে পারি যে, জীবনের যেকোনো দ্বিধা বা সংকটকালে ভগবানের উপদেশ আমাদের সাহস ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুধু অর্জুনের জন্য নয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সংকটের সময়ে পথ প্রদর্শক। 

শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষা আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণা যোগায়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধকে আরো গভীর করে তোলে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top