ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্ । উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি ॥২৫॥
অনুবাদ: ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য মহাশক্তিধরদের দেখে, পার্থকে (অর্জুনকে) বললেন, “দেখ এই কুরুকুলীয়দের যারা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছে।”
হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র গ্রন্থ ভগবদ্গীতায় প্রতিটি শ্লোকের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে এই শ্লোকটি বলেছিলেন, তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যাবার আগে অর্জুন তার আত্মীয়স্বজন ও গুরুদের দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরা তাঁর কাছে বড়ই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দ্বিধা কাটাতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যা বলেন, তা শুধু অর্জুনের জন্যই নয়, মানব জীবনের পথ চলার জন্যও এক গভীর শিক্ষা।
কুরুক্ষেত্রের প্রেক্ষাপটে এই শ্লোকের তাৎপর্য
অর্জুনের দ্বিধা এবং শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা
অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর গুরু ভীষ্ম এবং দ্রোণকে যুদ্ধের পক্ষে দেখতে পান, তখন তাঁর হৃদয় দুলে ওঠে। তাঁর কষ্টের কারণ ছিল তাঁর আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চিন্তা। ঠিক তখনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন এই বিখ্যাত শ্লোকটি। এর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কেবল যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়, জীবন যুদ্ধে কর্তব্য পালনের গুরুত্বও বুঝিয়েছিলেন।
কেন শ্রীকৃষ্ণ এই নির্দেশ দিলেন?
শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, যেকোনো ধর্মযুদ্ধ বা আদর্শ যুদ্ধের জন্য দ্বিধাহীন মন অত্যন্ত জরুরি। অর্জুনের দ্বিধা তাঁকে বিচলিত করেছিল, এবং এজন্য শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মনে করিয়ে দেন যে, কেবলমাত্র তাঁর প্রিয়জন নয়, জীবনের প্রয়োজনের জন্য কর্তব্য পালনে প্রস্তুত থাকা আবশ্যক। এভাবেই অর্জুনের ভিতরে শক্তি এবং দৃঢ়তা জাগিয়ে তোলেন তিনি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: একটি ধার্মিক সংকল্প
ভীষ্ম ও দ্রোণের উপস্থিতি
ভীষ্ম এবং দ্রোণ কেবল অর্জুনের জন্য গুরু কিংবা সম্মানের প্রতীকই ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন ন্যায় ও সত্যের অনুসারী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে একটি মহাযুদ্ধ। অর্জুনের দৃষ্টিতে, ভীষ্ম এবং দ্রোণের উপস্থিতি যুদ্ধের মহিমা আরও বাড়িয়ে তোলে, এবং এটি তাঁর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষার মতোই ছিল।
অর্জুনের মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব
অর্জুন যখন কুরুর বংশের সম্মানীয় যোদ্ধাদের দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর মনে এক বিরাট দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু—এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মনে করিয়ে দেন যে, এটা তাঁর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় নয়, বরং এটি কর্তব্য এবং ধর্মের বিষয়।
শ্রীকৃষ্ণের দীক্ষা: শ্রীমদ্ভাগবত গীতার শিক্ষা
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কেবলমাত্র সম্পর্কের ভিত্তিতেই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়; মানুষের জীবনে ধর্ম, কর্তব্য, এবং ন্যায়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এক গুরুমন্ত্র দেন যা আজও সকল ধর্মবিশ্বাসীর জন্য এক মহামন্ত্র হিসেবে কাজ করে।
ধর্ম ও কর্তব্য পালন: শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মানুষের জীবনে কর্তব্য পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কঠিন মনে হলেও, ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন।
মোক্ষের পথ: জীবনের আসল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মায়াজাল নয় বরং কর্তব্য ও ধর্ম পালন করে মোক্ষ লাভ করা।
ভগবদ্গীতার শ্লোকের প্রাসঙ্গিকতা আজকের জীবনে
শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ আজকের যুগে আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্ক ও কর্তব্যের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তা কাটিয়ে উঠতে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশনা মেনে চলা আবশ্যক। অনেকেই চাকরি, পরিবার, এবং সম্পর্কের দ্বন্দ্বে কষ্ট পেয়ে থাকেন। এই শ্লোকটি সেই দুঃখকে দূর করতে সাহায্য করে এবং মনকে দৃঢ় করে তোলে।
কিছু বাস্তব জীবনধর্মী শিক্ষা
ধর্মের জন্য সবকিছু ত্যাগ করাও কর্তব্য: জীবনযুদ্ধে অনেক সময় এমন আসে যখন আমাদেরকে ব্যক্তিগত ইচ্ছা ত্যাগ করে সমাজের জন্য কিছু করতে হয়।
মায়াজালে না ফেঁসে কর্তব্যের পথে চলা: পরিবার, বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা থাকা ভালো, কিন্তু ধর্ম এবং সত্যের পথে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।
ভগবদ্গীতার শিক্ষা এবং মানবজীবন
শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষাটি এমন এক অনন্য বার্তা যা আমাদের জীবনের প্রতিটি সংকটে সাহসী ও দৃঢ় মনোভাব নিয়ে চলতে শেখায়।