১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ২৭

১.২৭ঃ সহানুভূতির শক্তি?

শ্রীমদ্ভগবদগীতা হিন্দু ধর্মের এক মহাকাব্যিক গ্রন্থ, যা আমাদের জীবনকে আদর্শের পথে পরিচালিত করে। এই শাস্ত্রে অর্জুনের মানসিক অবস্থার সাথে আমরা আত্মার দ্বন্দ্ব, সংশয়, এবং জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশদভাবে পরিচিত হই। ২৭ নম্বর শ্লোকটি সেই সময়ের প্রতিচ্ছবি, যখন কৌন্তেয় অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে তার আত্মীয়স্বজনদের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখে মনের গভীর থেকে সহানুভূতির দ্বন্দ্বে পড়ে যান।  

 শ্লোকের ব্যাখ্যা 

“তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্।  

কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ ॥২৭॥”

শ্লোকের অর্থ হলো – “তখন অর্জুন তার সকল আত্মীয় ও বন্ধুদের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সহানুভূতির আবেগে পূর্ণ হয়ে যান এবং বিষাদে নিমগ্ন হন।”  

এই শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এখানে অর্জুনের মনোবল এবং বীরত্বের মাঝে বিরাট এক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়। তিনি কেবলমাত্র একজন যোদ্ধা নন, বরং একজন পিতা, ভাই এবং বন্ধু। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যখন নিজের আত্মীয় ও বন্ধুদের দেখেন, তখন তার মানসিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়।  

 কৃপা: সহানুভূতির শক্তি

কৃপা বা সহানুভূতি একজন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্জুনের সহানুভূতি ছিল গভীরভাবে সংযুক্ত একটি দ্বন্দ্বের মধ্যে।  

কিছু বিষয় যা আমরা অর্জুনের এই সহানুভূতি থেকে শিখতে পারি:

  •  অন্যের প্রতি সহানুভূতির অনুভূতি আমাদের মানসিক শক্তি হতে পারে।
  •  যখন আমরা দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হই, তখন নিজেকে বুঝতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
  •  সহানুভূতি আমাদের অন্তরের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে, যা আমাদের মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়।  

 অর্জুনের মনস্তত্ত্ব এবং মানবতার প্রতিচ্ছবি

অর্জুন তার ভাই, বন্ধু এবং শিক্ষককে দেখে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। এই মুহূর্তে তার মনে একটি মানবিক প্রতিক্রিয়া ঘটে, যা আমাদের শেখায় কীভাবে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এই শ্লোকের প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়, কঠিন পরিস্থিতিতে হিন্দু ধর্মের সহানুভূতির আদর্শ কতটা শক্তিশালী হতে পারে।

 গল্প: রামের মানবিক সহানুভূতি

রামের গল্পে আমরা আরেকটি উদাহরণ পাই, যেখানে তিনি সহানুভূতির মহান এক উদাহরণ স্থাপন করেন। যখন তিনি তার শত্রু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, তখনও তার মনে ছিল মানবতার চিন্তা। রাবণ যখন আহত হয়ে পড়ে, রাম তাকে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করেন। এই সহানুভূতির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তার আত্মার শক্তি।  

এই গল্পের শিক্ষণীয় দিকগুলো:

  •  আমাদের শত্রু বা প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান থাকা উচিত।
  •  মানবতার গুণাবলী আমাদের বৃহৎ আদর্শে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

 শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ: ধর্ম এবং কর্তব্য

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, জীবন এক সংগ্রাম, যেখানে কর্তব্যপালন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি বলেন, মনের এই সহানুভূতি সহনশীলতা ও মানবতার পরিচয় দেয়, কিন্তু ধর্মের পথে থাকতে গেলে কখনও কখনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।  

কর্তব্য পালন নিয়ে কৃষ্ণের শিক্ষণীয় বার্তা:

  •  জীবন সংগ্রামে আমাদের কর্তব্যই আমাদের প্রধান।
  •  মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কখনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

 অর্জুনের মতো দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?

  •  নিজের ভেতরের কন্ঠস্বর শুনুন এবং সহানুভূতির সাথে সিদ্ধান্ত নিন।
  •  মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কঠিন সিদ্ধান্ত নিন।
  •  শাস্ত্রের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিন এবং তা পালন করুন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার এই শ্লোক আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। অর্জুনের মত, আমরা সকলেই জীবনযুদ্ধে নিজেদের দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হই, যেখানে আমাদের সহানুভূতি এবং মানবতার শিক্ষা আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top