১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ২৯

১.২৯ঃ  অর্জুন ও আপনার মনোভাবের সামঞ্জস্য

ভগবদ্ গীতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি মূল্যবান নির্দেশিকা প্রদান করে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ জীবনের নানা সংকট মোকাবেলায় অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন। আজ আমরা এই মহান গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৯ নম্বর শ্লোকটি আলোচনা করবো। অর্জুনের ভিতরে যে দ্বিধা এবং ভীতির জন্ম নিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে, সেটি সমকালীন পৃথিবীর সাথেও বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের জীবনের প্রতিটি সমস্যায় এই শ্লোক থেকে আমরা এক মহৎ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি।

 শ্লোক ২৯: ভগবদ্ গীতার মূল ভাবনা

“বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে। গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে ॥২৯॥”

অর্থ:  

আমার দেহ কাঁপছে এবং গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। আমার গাণ্ডীব ধনুক হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে এবং ত্বক জ্বালা করছে।

এই শ্লোকটিতে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে তার মনের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন। যুদ্ধের ভয় এবং নৈতিক দ্বন্দ্ব তাকে গভীর মানসিক উত্তেজনার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। তার শরীর কাঁপছে, হাতের ধনুক পড়ে যাচ্ছে, আর ত্বক যেন দগ্ধ হচ্ছে। এটি এক শক্তিশালী চিত্র, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহস এবং ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেয়।

 অর্জুনের কাঁপন এবং আমাদের মনোভাবের সামঞ্জস্য

অর্জুন এখানে আসলে ভয়, দুশ্চিন্তা এবং নৈতিক সংকটে আছেন। এই অবস্থানকে আমরা আধুনিক জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি যেখানে নানা সিদ্ধান্তহীনতা, দুশ্চিন্তা এবং ভয় আমাদের বিপথগামী করে তুলতে পারে।

  •  নৈতিক দ্বন্দ্ব: প্রতিদিন আমরা জীবনের নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, যেগুলি হয়তো আমাদের নৈতিকতার সাথে মিল খায় না।
  •  শারীরিক প্রতিক্রিয়া: অনেক সময় আমরা এমন অবস্থার মধ্যে পড়ি, যখন আমাদের শরীরও মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া জানায়।
  •  ধনুক ছেড়ে দেওয়া: জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে কখনও আমরা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে চাই। 

 কেন শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয়?

এই শ্লোকটিতে অর্জুন তার দেহের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলেছেন। ভগবদ্ গীতায় বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে চেয়েছেন যে দেহের প্রতিক্রিয়া তার মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। এই অনুভূতি যেমন হতাশা এবং কাঁপন সৃষ্টিকারী পরিস্থিতির প্রতিফলন, তেমনই সেটি অর্জুনের দায়িত্ব পালনে দ্বিধার চিহ্ন।

 কিভাবে আমরা অর্জুনের মতো ভীত এবং দিশেহারা হয়ে উঠি?

  •  যখন আমরা সঠিক পথ খুঁজে পাই না
  •  নৈতিকতাকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়
  •  কখনো কখনো দায়িত্বকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে

 ভক্তিমূলক গল্প: অর্জুনের সংকল্পের শক্তি

গীতার এই পর্বে অর্জুন যেন এক দিশেহারা প্রাণী। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন যে সত্যকারের যোদ্ধা কখনো দায়িত্ব থেকে পিছু হটে না। ভগবানের অনুগ্রহে যোদ্ধা তার সংকল্পে দৃঢ় হয়ে ওঠে। শ্রীকৃষ্ণের এই বক্তব্য অর্জুনের মনোবলকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অর্জুনকে এমন এক শক্তি এবং সাহস দেয়, যার ফলে তিনি নিজের দায়িত্ব এবং কৃতজ্ঞতায় দৃঢ় হন। 

এখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্য থেকে দুটি মূল শিক্ষা নিতে পারি:

  •  আত্মবিশ্বাস বজায় রাখা: ভগবানের উপর বিশ্বাস রেখে আত্মবিশ্বাস অর্জন করা।
  •  ধৈর্য ধারণ করা: কোন পরিস্থিতিতেই ধৈর্য হারিয়ে না ফেলা।

 শারীরিক কষ্ট এবং মানসিক স্থিতিশীলতা: কীভাবে সামঞ্জস্য বজায় রাখা যায়?

মানসিক চাপ আমাদের শারীরিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমনটি অর্জুনের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তগুলোতে ধৈর্য এবং মানসিক শক্তি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

 নিজেকে স্থির রাখার উপায়:

  •  ধ্যান এবং প্রার্থনা: মানসিক প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভের জন্য প্রতিদিনের ধ্যান এবং প্রার্থনা।
  •  শারীরিক কসরত: শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলে মানসিক দৃঢ়তা অর্জন সহজ হয়।
  •  বিরত থাকুন: কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে একবার বিরতি দিন, শান্ত হওয়ার জন্য সময় নিন।

 ভগবদ্ গীতার শিক্ষা এবং আধুনিক জীবনে এর প্রভাব

ভগবদ্ গীতার শ্লোকগুলি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অর্জুনের দুর্বলতা এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ আমাদের জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে নির্দেশিকা হতে পারে। 

আমরা কখনো কখনো দুশ্চিন্তা, দুঃখ, এবং দ্বিধায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু তখন আমাদের ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে এবং ধৈর্য সহকারে এগিয়ে যেতে হবে।

 গীতার নির্দেশনা: সংকল্প ও ধৈর্য

অর্জুন যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন যে, জীবনের সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার জন্য শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। সেই দিকনির্দেশনা গীতা আমাদের দেয় এবং আমাদের মনোবলকে শক্তিশালী করে।

অর্জুনের দ্বিধা এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ আমাদের জন্য এক দৃষ্টান্ত। আমরা যেন জীবনের প্রতিটি সংকটে ধৈর্য এবং সংকল্প ধরে রাখতে পারি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top