“ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রমতী চ মে মনঃ। নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব॥
এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে অর্জুন তাঁর মনের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা ভাগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানাচ্ছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে তাঁর মন যখন বিষন্নতা, সংশয় এবং সংকটের দ্বারা আচ্ছন্ন, তখন তিনি এই কথাগুলি বলেন।
অর্জুনের অন্তর্দ্বন্দ্ব: এক অন্তর্দাহ
কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অর্জুন যে সংকটে পড়েছিলেন, তা শুধু একজন যোদ্ধার সংকট নয়, এটি মানব মনের দ্বিধা, অনিশ্চয়তা এবং মোহের এক প্রতীক। যখন আমাদের জীবনে বড় কোনো সংকট আসে, তখন প্রায়শই আমরা অর্জুনের মতই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ি।
- ভ্রমতী চ মনঃ: অর্জুন বলছেন, “আমার মন যেন প্রতিনিয়ত দোল খাচ্ছে”। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব?
- নিমিত্তানি বিপরীতানি: অর্থাৎ চারপাশের লক্ষণগুলো তার কাছে বিপরীত বলে মনে হচ্ছে, যা তাকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করছে। এটি আমাদের জীবনের সেই মুহূর্তকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন আমাদের মনও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মীয় আনুগত্য
হিন্দু ধর্মে আমরা বিশ্বাস করি যে জীবনের প্রতিটি সংকট আমাদের আত্মার উন্নতির জন্য এক নতুন অধ্যায়। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই সংকটে অভয় দিতে চান এবং তাঁকে তার কর্তব্য পালনের জন্য প্রস্তুত করতে চান। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে:
- ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রাখা জরুরি: সংকটের সময়ে আমাদের মন ভ্রমণ করে, তবে আমাদের উচিত ভগবানের নির্দেশনা গ্রহণ করা।
- কর্ম ও কর্তব্য: হিন্দু ধর্মে কর্মকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম থেকে পলায়ন নয়, বরং তা পালনই সঠিক পথ।
অর্জুনের অবস্থা: আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি
আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্বে আমরা অর্জুনের এই সংকটকে অনুভব করি। জীবন যখন কঠিন হয়ে ওঠে এবং চারপাশের সবকিছুই বিপরীতমুখী বলে মনে হয়, তখন আমাদের মন স্থির থাকতে চায় না। এটি ঘটে যখন আমাদের:
- আত্মবিশ্বাস কমে যায়।
- পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ণয় করতে পারি না।
- মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।
অর্জুন যেমন শ্রীকৃষ্ণের সাহায্য চেয়েছিলেন, তেমন আমরাও সৃষ্টিকর্তার আশ্রয় নিতে পারি।
এক ধর্মীয় কাহিনী: প্রহ্লাদ ও হিরণ্যকশ্যপের গল্প
এই প্রসঙ্গে আমরা প্রহ্লাদ এবং হিরণ্যকশ্যপের গল্পটি আলোচনা করতে পারি, যা এই শ্লোকের ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হিরণ্যকশ্যপের অত্যাচারের মুখেও প্রহ্লাদ তার ভগবান বিষ্ণুর প্রতি বিশ্বাস ধরে রেখেছিল। তিনি কষ্টে থেকেও বিশ্বাস হারাননি, এবং শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ থেকেই আমরা শিখতে পারি যে বিপরীত পরিস্থিতিতেও আমাদের বিশ্বাস স্থির রাখতে হবে।
সংকটময় সময়ে কীভাবে অর্জুনের শিক্ষাকে কাজে লাগানো যায়?
হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই শ্লোকটি সংকটের সময় কীভাবে ধৈর্য ও সাহস ধরে রাখতে হয় তা শিক্ষা দেয়। অর্জুন যেভাবে কৃষ্ণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, তেমনই আমরা এই দীক্ষা নিতে পারি।
কিভাবে সংকটের মুখোমুখি হবেন?
- ভগবানের শরণাপন্ন হন: ঈশ্বর সর্বদা আমাদের পাশে আছেন। তার প্রতি আস্থা রাখুন।
- মনের অবস্থাকে বুঝুন: কখনো কখনো মন স্থির থাকেনা, কিন্তু নিজের উপর আস্থা রাখতে হবে।
- ভয়কে পরাস্ত করুন: অর্জুন যেমন ভয় ও দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছেন, আপনিও সেই পথে এগোতে পারেন।
অর্জুন ও কৃষ্ণের কথোপকথনের শিক্ষা
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই পর্বে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে চান যে, এই মনোস্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাস কীভাবে তাঁকে ধর্মের পথে থাকতে সাহায্য করবে। এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক যখন:
- আমরা নিজের উপর আস্থা হারাই।
- সংকট থেকে পালাতে চাই।
- চারপাশের পরিবেশকে বিপরীত মনে হয়।
জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার মন্ত্র: কৃষ্ণের উপদেশ
কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে আমরা কেবল আমাদের কর্তব্য পালন করব, ফলাফলের চিন্তা করব না। এই জীবনদর্শন আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে সাহায্য করতে পারে। সংকটের সময় এই কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করলে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখা সহজ হয়:
- ভক্তি ও বিশ্বাস: সংকট যতই গভীর হোক, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না।
- সংযম ও ধৈর্য: ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করুন।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: সংকট আপনার ক্ষমতার পরীক্ষা নেয়, তাই আত্মবিশ্বাস রাখুন।
এই শ্লোকের ভাবনা শুধু একটি ধর্মীয় নির্দেশনা নয়; এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শক্তি, ধৈর্য ও বিশ্বাসের শিক্ষা দেয়। অর্জুনের ভ্রমাতী মন ও বিপরীত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আমরা শিখি কীভাবে মানসিক অস্থিরতা এবং দুঃখজনক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যায়।
অতএব, সংকটকালে এই শ্লোকের মাধ্যমে প্রেরণা গ্রহণ করে আমরা আমাদের মনকে স্থির রাখতে এবং জীবনের সকল পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারি।