১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৩১

১.৩১ঃ মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা?

“ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে । ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ॥৩১॥”

এই শ্লোকটি ভগবদ্‌গীতার এক গভীর অধ্যায়ের অংশ। এখানে অর্জুন এক অদ্ভুত মানসিক দ্বিধায় ভুগছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুন তার আপনজনদের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত নন। এই শ্লোকের মধ্যে দিয়ে তিনি শ্রেয়ঃ (সর্বোত্তম গুণ) এর সন্ধান করছেন, যা তাকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দেবে।

 শ্লোকটির ভাবার্থ

এই শ্লোকে অর্জুন তার প্রিয় বন্ধু এবং গুরু কৃষ্ণকে জানান যে তিনি এই যুদ্ধ থেকে কোন কল্যাণ দেখছেন না। সবার সাথে যুদ্ধ করে এবং আপনজনদের হত্যা করে কোন বিজয়, রাজ্য বা সুখের লোভ তার নেই। তিনি ভাবছেন, যদি আপনজনদের বিনাশ করেই রাজ্য পাওয়া যায়, তবে সেই রাজ্য গ্রহণ করাটা অর্থহীন।

 অর্জুনের দ্বিধা: মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা

এই শ্লোকের মাধ্যমে অর্জুন আমাদের শেখান যে কখনো কখনো আমাদের সামাজিক এবং মানবিক দায়িত্ব আমাদের ধর্ম বা কর্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তিনি নিজে এক যোদ্ধা হলেও তার হৃদয় কোমল। আপনজনদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এই বাধ্যবাধকতায় তিনি দ্বিধান্বিত। এটা এক প্রাচীন মানবিক দোটানা, যা আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। 

 ধর্ম ও কর্তব্যের দ্বন্দ্ব

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গুলিতে বারবার আমরা ধর্ম ও কর্তব্যের দোটানার উদাহরণ পাই। 

  •  রামায়ণে দেখা যায়, রামের পিতার নির্দেশ মেনে বনবাসে যাওয়ার ঘটনা, যা তার ব্যক্তিগত সুখ ত্যাগের এক উদাহরণ।  
  •  মহাভারতে আবার ভীষ্মের কথা, যিনি কৌরবদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখিয়েছেন শুধুমাত্র তাদের প্রতি তার কর্তব্যবোধের কারণে।

অর্জুনের এই শ্লোকে বোঝা যায় যে সত্যিকার ধর্মীয় উপলব্ধি মানে শুধু কর্তব্য পালন নয়, বরং তা মানবিকতার সাথে গভীরভাবে জড়িত।

 অর্জুনের আত্মিক প্রশ্ন: কীভাবে আত্মাকে শান্তি দেওয়া সম্ভব?

এই শ্লোকের মাধ্যমে অর্জুন শুধুই তার আত্মিক প্রশ্নই তুলে ধরেন না, বরং মানবিকতার শিকড়ে প্রবেশ করেন। আত্মার শান্তির জন্য কী প্রয়োজন? আপনার জীবনে যদি অর্জুনের মতো কোন দ্বন্দ্ব আসে, তাহলে আপনাকে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, মানবিকতা এবং আত্মিক শান্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে।

 কৃষ্ণের উত্তর: সত্যিকার কল্যাণ কোথায়?

যদিও অর্জুনের এই দ্বিধা স্বাভাবিক, কৃষ্ণ তাকে মনে করিয়ে দেন যে ব্যক্তিগত ভালোমন্দের ঊর্ধ্বে ধর্ম ও কর্তব্য পালনের গুরুত্ব অনেক বড়। কৃষ্ণের শিক্ষা অনুযায়ী, আত্মার শান্তি আসে যখন আমরা আমাদের স্বার্থত্যাগ করে পরের মঙ্গল কামনায় নিজেকে উৎসর্গ করি। তাই এই পরিস্থিতিতে অর্জুনের জন্য নিজের ধর্ম (ক্ষত্রিয় ধর্ম) পালন করা শ্রেয়।

 ধর্মীয় গল্পের মাধ্যমে শ্লোকের ব্যাখ্যা

এই শ্লোকের তাৎপর্য বোঝার জন্য একটি প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় কাহিনি বলা যেতে পারে:

 গল্প: পরশুরামের কল্পনা ও তার আত্মিক সংগ্রাম

একবার পরশুরাম তার পিতার আদেশে তাঁর মায়ের ওপর অস্ত্র তোলার জন্য বাধ্য হন। যদিও তার মনের গভীরে কষ্ট ছিল, তিনি পিতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আদেশ মেনে নেন। এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি শিখলেন যে, কখনো কখনো কর্তব্য পালনের জন্য কষ্টস্বীকার করতে হয়। তবে পরবর্তীতে পিতা নিজেই তার সন্তানকে আশীর্বাদ করেন এবং পরশুরামকে আশীর্বাদ দেন, যার ফলে তিনি আত্মিক শান্তি ও ধর্ম পালনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারেন।  

এই কাহিনি অর্জুনের দ্বিধার সাথে সম্পর্কিত কারণ এখানেও আত্মিক শান্তি এবং ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্বের উদাহরণ পাওয়া যায়।

 শ্লোক থেকে প্রাপ্ত পাঠ

  • মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা  অর্জুন বোঝাতে চান যে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • আত্মার শান্তি খোঁজা  আমাদের সকলের উচিত এমন পথে চলা, যা আমাদের আত্মিক শান্তি এনে দেয় এবং আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে।
  •  ধর্ম ও কর্তব্যের সঠিক ভারসাম্য  এই শ্লোক আমাদের শেখায় কীভাবে মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ধর্ম এবং কর্তব্য পালন করা যায়।

 অর্জুনের এই শিক্ষা আমাদের জীবনে কীভাবে কাজে লাগতে পারে?

আমরা সকলেই জীবনে এমন অনেক মুহূর্তের মুখোমুখি হই যেখানে আমাদের কর্তব্য পালন এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে সংঘাত হয়। এই শ্লোক আমাদের শেখায়:

  •  আত্মার শান্তি কোথায় পাওয়া যায়?
  •  যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ধর্ম ও মানবিকতার প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা।

এই শ্লোকটি অর্জুনের দ্বিধা ও তার মানবিকতা প্রকাশ করে। তিনি জিততে চান, কিন্তু সেই জয়ের পেছনে যদি স্বজনদের জীবন নাশ হয়, তবে সেই জয়কে তিনি অর্থহীন মনে করেন। এই দ্বিধা আমাদের শেখায় যে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শুধু বাহ্যিক ধর্ম নয়, আমাদের অন্তরের দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top