শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ অংশ যেখানে শ্রীকৃষ্ণের বাণী আর্সেন আরজুনের জীবনের মানে বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে। শ্লোক ৩২এ শ্রীকৃষ্ণ আরজুনের কাছে এই প্রশ্ন রাখছেন যে, “যদি সত্যিকারের শান্তি ও সুখ না পাওয়া যায়, তবে রাজ্য, ভোগ বা এমনকি জীবন কি কোনো অর্থ বহন করে?” এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কথা, যা প্রতিটি হিন্দু ধর্মের অনুসারীকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে।
“কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা ।
যেষামর্থে কাংক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ ॥”
শ্লোকটির বিশ্লেষণ
শ্লোকটির ব্যাখ্যায় দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ আরজুনকে বোঝাচ্ছেন যে জীবনের সাফল্যের জন্য কেবল রাজ্য বা সম্পত্তি বা ভোগের প্রয়োজন নেই। এই বিশ্ব সংসারে মানুষের আসল লক্ষ্য হলো মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করা এবং নিজ নিজ কর্তব্য পালন করা।
শ্লোকটি বাংলা অর্থে:
“হে গোবিন্দ, আমাদের জন্য কি রাজ্য প্রয়োজন, বা ভোগবিলাসে বেঁচে থাকা সত্যিই মূল্যবান? যাদের জন্য এই রাজ্য, ভোগ ও সুখের ইচ্ছা ছিল, তাদের তো সবাই এখানে আছে।”
রাজ্য ও ভোগের মায়া
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই বিশেষ শ্লোকটি আসলে জীবনের মূল্যবোধের উপর জোর দেয়। আরজুনকে বোঝানোর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ আসলে আমাদের সকলকেই এই শিক্ষাটি দিচ্ছেন যে, বাহ্যিক সফলতা বা আর্থিক সম্পদের মায়া আসলে অস্থায়ী। মনুষ্য জীবনে ধনসম্পদের চেয়ে আরো বড় কিছু রয়েছে, যা আমাদের জীবনকে সত্যিকার অর্থে পূর্ণতা দেয়।
শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা
আমাদের বর্তমান জীবনে এই শ্লোকটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা প্রতিদিনের জীবনে ঘটে চলা ঘটনাগুলোর দিকে তাকাতে পারি। অধিকাংশ সময়েই আমরা অর্থ, ক্ষমতা এবং অবস্থানের পিছনে ছুটে থাকি, কিন্তু আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে সরে আসি। এর ফলস্বরূপ আমাদের জীবনে অশান্তি এবং অসন্তুষ্টি জেগে ওঠে।
একটি ছোট গল্প: কৃষ্ণ এবং সুধামার বন্ধুত্ব
একবার শ্রীকৃষ্ণের খুব কাছের বন্ধু সুধামা তাঁকে দেখতে এলেন। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন কিন্তু তাঁর মনের ভাবনাটি ছিল অত্যন্ত বিশুদ্ধ। যখন সুধামা শ্রীকৃষ্ণের কাছে পৌঁছান, কৃষ্ণ তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার সাথে গ্রহণ করেন। কৃষ্ণের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার পরেও সুধামার চাহিদা ছিল না; বরং তিনি তাঁর বন্ধুর মুখে হাসি দেখতে চেয়েছিলেন।
কৃষ্ণ তখন তাঁর প্রাচুর্যের সমস্ত কিছু দেখিয়েও সুধামাকে বোঝান যে, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার মূল্য কোনো ধনসম্পদ দিয়ে বিচার করা যায় না। কৃষ্ণের এই আচরণের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, জীবনের আসল সম্পদ আমাদের নৈতিকতা, ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা। রাজ্য বা সম্পত্তি নয়, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা।
জীবনের মূল্যবোধ এবং আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা
হিন্দু ধর্মের শিক্ষা অনুসারে, এই দেহ আর এই জীবন মায়াময়। আমরা যদি মনে করি যে ধনসম্পদ, ক্ষমতা, বা ভোগ আমাদের শান্তি দিতে পারবে, তবে আমরা ভ্রমে রয়েছি। শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকে বোঝাচ্ছেন, কেবল বাহ্যিক সাফল্য দিয়ে জীবনকে সার্থক করা সম্ভব নয়, বরং আমাদের আত্মা এবং মনকে শুদ্ধ করাই হলো আসল সাফল্য।
আরজুনের বিভ্রান্তি এবং আমাদের জীবনের বাস্তবতা
এই শ্লোকটিতে আরজুনের দ্বিধার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উত্তর রয়েছে। আরজুন নিজেই জানতে চেয়েছেন, যুদ্ধ জেতার পরেও যদি শান্তি ও আনন্দ না পাওয়া যায়, তবে এই জয়ের মূল্য কী? শ্রীকৃষ্ণ আমাদের জীবনে লক্ষ্য রাখার গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন, যাতে আমরা জীবনকে অন্যদের জন্য উৎসর্গ করতে পারি এবং সর্বোচ্চ আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারি।
এই শ্লোক থেকে কী শিক্ষা নেবো?
এই শ্লোক থেকে আমরা কিছু মূল্যবান শিক্ষা পেতে পারি, যা আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক:
- লোভ এবং অহংকার ত্যাগ করুন: জীবনকে সুখী করতে ধনসম্পদের জন্য লোভ এবং অহংকার দূর করা জরুরি।
- কর্তব্য এবং ধর্ম পালন: ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে সমাজ ও পৃথিবীর জন্য কিছু করার চেষ্টা করুন।
- অন্তরকে পরিষ্কার রাখুন: বাহ্যিক সম্পদের পরিবর্তে নিজের অন্তরকে সুন্দর এবং শুদ্ধ রাখার জন্য মনোযোগ দিন।
জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে নেওয়া
শেষ পর্যন্ত, এই শ্লোকটি আমাদের শেখায় যে বাহ্যিক সাফল্য বা প্রাচুর্যই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য নয়। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে, আমাদের উচিত সেই পথ অনুসরণ করা, যা আমাদের সত্যিকার আত্মিক উন্নতি এবং মনুষ্যত্বের পূর্ণতা দিতে পারে।