১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৩৪

১.৩৪ঃ  ধর্ম ও মানবতার মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রকাশ

“মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা ।  

এতান্ন হন্তমিচ্ছামি ঘ্নতহপি মধুসূদন ॥”

গীতা অনুসারে এই শ্লোকটি যোদ্ধা অর্জুনের গভীর দ্বন্দ্ব এবং হৃদয়ের এক বেদনাবিধুর আবেগ প্রকাশ করে, যেখানে সে তার আত্মীয়স্বজন, পরিবার এবং বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক। শ্রীকৃষ্ণের সামনে দাঁড়িয়ে, অর্জুন তার ভাবনার গভীরে নিজের অবস্থান ও ধর্মকে পর্যালোচনা করেন। এ যেন শুধু একটি শ্লোক নয়, বরং এক জীবনের গভীর প্রশ্ন, যেখানে ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবতার মূল্যে দ্বিধাবিভক্ত। 

 শ্লোকের মূল অর্থ ও তার গভীরতা

অর্জুন তার মাতুল (মামা), শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালা, এবং অন্যান্য আত্মীয়দের জীবন নেয়ার পক্ষে নন। তিনি স্পষ্টতই বলছেন, “মধুসূদন, আমি তাদের হত্যা করতে চাই না।” এই কথার মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এবং নৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। 

অর্জুনের এই অবস্থান আমাদের শেখায় যে জীবনের কিছু প্রশ্নের উত্তরের জন্য শুধু বাহ্যিক নয়, আত্মার গভীরতায় প্রবেশ করা প্রয়োজন। এখানে অর্জুনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়, তা মানবিকতায় জড়িত এবং ধর্মীয় স্তরে গভীর অর্থপূর্ণ। 

 ধর্ম ও মানবতার মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রকাশ

অর্জুনের এই দ্বিধা আমাদের শেখায় যে প্রায়শই আমাদের জীবনে বড় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আমরা এমন দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হই, যেখানে ধর্ম এবং নৈতিকতাকে একসঙ্গে মেলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন আমাদের হৃদয় মানবিকতায় পূর্ণ থাকে এবং মন ধর্মের পথে থাকে। তখন আমরা ভাবতে শুরু করি, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ: ধর্ম পালন করা, না মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করা?

  •  ধর্মের পথে বাধা: অর্জুন যুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন, কারণ তার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ মানেই আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জনদের হত্যা।
  •  মানবতার পথ: অর্জুনের অন্তরে মানবতার স্পর্শ দেখা যায়, যেখানে তিনি নিজের প্রিয়জনদের বেঁচে থাকার মূল্য উপলব্ধি করেন।

 শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ ও আমাদের শিক্ষা

এই শ্লোকটি পড়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, অর্জুন কি তার ধর্মের বিরোধিতা করছেন? না, বরং তিনি কেবল নিজেকে প্রশ্ন করছেন। শ্রীকৃষ্ণ, যিনি অর্জুনের চেতনার এক অনন্য শিক্ষক, তাকে বোঝাচ্ছেন যে সত্যিকারের ধর্ম পালন করতে হলে নৈতিকতা, মানবিকতা, এবং জীবনবোধের সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন। 

 একটি ছোট্ট ধর্মীয় কাহিনী: রামের সীতাহরণ ও অর্জুনের যুদ্ধ

যখন রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কার রাজা রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখনও একটি নৈতিক দ্বন্দ্বের সঞ্চার হয়। রাম জানতেন, যুদ্ধের ফলে অনেক জীবনহানি ঘটবে। তবুও তিনি তার ধর্মীয় কর্তব্য পালন করেন কারণ সেটিই ছিল মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়। অর্জুনের মতো, রামও মানবতার দিকে মনোযোগ দেন এবং মানুষের জন্য ধর্মকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হন। 

 এই শ্লোকের মাধ্যমে জীবন ও ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা

এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে কেবল ধর্ম বা মানবতার মধ্যে একটি বেছে নেয়া কঠিন। তবে যখনই দ্বন্দ্ব আসে, তখন নিজের অন্তরের সাথে যুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুন তার পরিবারের মানুষদের প্রাণ নিতে চান না, কারণ এতে তার নিজস্ব মানবতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

  •  ধর্ম পালন করতে গিয়ে যে বাধা আসে: অর্জুনের মতই আমরা অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্ত হই, কারণ আমরা মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চাই।
  •  শ্রদ্ধার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া: অর্জুনের অন্তরের দ্বন্দ্ব আমাদের শেখায় যে, সবসময় শ্রদ্ধার সাথে নিজের অন্তরের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

 আমাদের জীবনে শ্লোকটির প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমানে, আমরা প্রায়ই এমন পরিস্থিতিতে পড়ি যেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক মানদণ্ড মেনে চলতে গিয়ে নিজের মূল্যবোধের সাথে দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। এই শ্লোকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমাদের সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে মানবতার স্পর্শ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম পালন করতে গিয়ে কখনো মানবতার সাথে আপোষ না করাই শ্রেষ্ঠ পথ।

 অর্জুনের সিদ্ধান্ত ও আমাদের ভাবনা

অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ মেনে যুদ্ধ করেন, কিন্তু তার অন্তরের প্রশ্ন সবসময়ই আমাদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তার দায়িত্বের দিকে নিয়ে যান, যাতে তিনি ধর্ম এবং মানবতার সঠিক সমন্বয় খুঁজে পান। শ্লোকটি আমাদের জন্য গভীর অর্থ বহন করে, কারণ এটি জীবন, ধর্ম এবং মানবতার মধ্যে একটি অনন্য সংযোগ স্থাপন করে। 

অতএব, গীতার এই শ্লোকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা যদি সত্যিকার অর্থে অন্তরের কথা শুনে এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সিদ্ধান্ত নেই, তবে সেটিই হবে প্রকৃত ধর্ম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top