শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শ্লোক ২.৩৫এ অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার নিকট আত্মীয়দের হত্যা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন, তখন তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামনে তার দোটানা প্রকাশ করেন। শ্লোকে অর্জুন বলেন, “ত্রৈলোক্যের রাজ্যও যদি লাভ হয়, তবুও এই পৃথিবীর জন্য ধার্তরাষ্ট্রদের হত্যা করে আমি কীভাবে সুখী হব?” এই শ্লোকটিতে অর্জুনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা এবং মানবিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন: একটি মানসিক যুদ্ধ
অর্জুনের প্রশ্নে মানবিকতা এবং ধর্মের মধ্যে একটি গভীর সংঘর্ষ দেখা যায়। ধার্তরাষ্ট্ররা শত্রু হলেও, তারা তার আত্মীয়, এবং তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে তিনি দ্বিধান্বিত। শ্রীকৃষ্ণ তখন বুঝিয়ে দেন, এটি শুধুমাত্র আত্মীয়তার বা ব্যক্তি সম্পর্কের প্রশ্ন নয়, বরং ধর্মের, অর্থাৎ পবিত্র কর্তব্য বা দায়িত্বের প্রশ্ন।
অর্জুনের অনুভূতি: যুদ্ধ ও মানবিকতা
অর্জুনের মূল চিন্তা ছিল:
- ত্রৈলোক্য বা তিনটি জগতের রাজ্যও যদি পাওয়া যায়, তা হলেও তাকে নিজের আত্মীয়দের হত্যা করতে হবে।
- যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে রাজ্য, সম্পদ, এবং মানমর্যাদা অর্জন হবে তা কি যথেষ্ট পরিমাণে সুখ প্রদান করবে?
- অর্জুন ভাবেন, “ধার্তরাষ্ট্রদের হত্যা করে যে ফলাফল পাব, তা কি শান্তি ও আনন্দ দিতে পারবে?”
এই প্রশ্নগুলির মাধ্যমে অর্জুন আমাদের মনে করিয়ে দেন, যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু জয়ের জন্য নয়, বরং মানবজাতির কল্যাণের জন্য হওয়া উচিত।
একটি শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ: ধর্ম বনাম সম্পর্ক
হিন্দু ধর্মে ধর্ম পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। এখানে ধর্ম বলতে শুধু পূজাঅর্চনা নয়, বরং নৈতিকতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারাকে বোঝায়।
ধর্মের সঠিক ধারণা
ধর্ম মানেই আমাদের দায়িত্ব পালনের পথ এবং সমাজের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুযায়ী, অর্জুনের দায়িত্ব ছিল তার পরিবারের প্রতি নয়, বরং বৃহত্তর সমাজের কল্যাণের প্রতি। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন,
> “ধর্মের পথে তুমি যে কাজ করবে তা কোনও দিন নষ্ট হবে না।”
গীতার শিক্ষার চিরকালীন প্রাসঙ্গিকতা
এই শ্লোকের শিক্ষাটি প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান, বিশেষত আজকের যুগে। বর্তমানে মানুষ প্রায়ই দোটানায় পড়ে যান যে তাদের নৈতিকতার কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি হার মানবে কিনা।
একটি ছোট গল্প: প্রহ্লাদ ও হিরণ্যকশিপুর কাহিনী
হিরণ্যকশিপু, অসুররাজ, ছিলেন অত্যন্ত অহংকারী এবং নিজেকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার ছেলে প্রহ্লাদ ছিলেন পরম ভক্তি ও ভগবৎপ্রেমে আপ্লুত। প্রহ্লাদ কোনওদিন তার বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেননি, কিন্তু ধর্মের প্রতি তার বিশ্বাস কখনও কমেনি।
এই গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয়:
- সত্যিকার অর্থে ধর্ম মানে নিজের দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করা।
- প্রহ্লাদ তার বাবাকে ভালোবাসলেও কখনও সত্যের পথে থেকে সরে আসেননি।
এই গল্পটি অর্জুনের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়; অর্জুনকেও নিজের আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা থাকার পরও ধর্মের পথে স্থির থাকতে হয়।
গীতার শ্লোকের শিক্ষা: যুদ্ধ নয়, মনের দ্বন্দ্ব
গীতার এই শ্লোক আমাদের বলে যে যুদ্ধ শুধু বাহ্যিক নয়, বরং মনের ভেতরের দ্বন্দ্বকে বোঝায়। অর্জুনের প্রশ্ন এবং শ্রীকৃষ্ণের উত্তর আমাদের জানায় যে আমাদের জীবনেও যখন দ্বন্দ্ব আসে, তখন আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে।
এই শ্লোক থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
- ধর্মের পথে থাকুন:
শুধু ব্যক্তিগত সুখ নয়, বরং সামগ্রিক মঙ্গল চিন্তা করতে হবে।
নিজের কর্তব্য এবং নৈতিকতার প্রতি সৎ থাকুন।
- কর্তব্যকে সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দিন:
সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, নিজের দায়িত্ব কখনো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
- সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য মানসিক শক্তি প্রয়োজন:
আত্মোপলব্ধি এবং ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নিজের মানসিক দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করুন।
- সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের প্রতি দায়িত্ব পালন:
ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে সমাজের মঙ্গলকেই গুরুত্ব দিন।
এই শ্লোকের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
এই শ্লোকটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যক্তিগত সুখ, সম্পদ বা সম্পর্কের চেয়ে আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব সর্বোচ্চ। গীতার শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা সকলেই এক বৃহত্তর মঙ্গল ও কল্যাণের অংশ এবং সেই পথেই আমাদের ধাবিত হওয়া উচিত।
এইভাবে, গীতার শ্লোকগুলি জীবন পরিচালনার এক অনন্য দর্শন হিসেবে কাজ করে, যা বর্তমান যুগেও মানবিক ও নৈতিকতার পথে নির্দেশ দেয়।