“পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ॥”
এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের একটি অমুল্য শিক্ষা, যেখানে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশ্ন করছেন—“আমার নিজের ভাইবোনদের, বন্ধুদের, আত্মীয়স্বজনদের হত্যা করে কীভাবে আমি সুখী হতে পারি?” এই প্রশ্নটি যেমন ব্যাক্তিগতভাবে আমাদের গভীর মানসিক দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরে, তেমনি তা আমাদের জীবন, ধর্ম এবং মানবিকতার প্রশ্নগুলোর সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
এই শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থ
শ্লোকে ‘পাপ’ শব্দটি এসেছে অর্জুনের মানসিক যন্ত্রণাকে বোঝাতে। আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করার ফলে যে পাপ অর্জুনের উপর আসবে, সেই ভীতিতে তিনি উদ্বিগ্ন। এখানে ‘আততায়িনঃ’ বলতে শত্রুদের বোঝানো হয়েছে, যারা অন্যায় ও অধর্মের পথে হাঁটছে। তথাপি অর্জুন মনে করেন, তাদের হত্যা করলে তার জীবন পাপময় হয়ে যাবে। এখানেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে তিনি পরামর্শ চাইছেন।
কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন?
অর্জুন যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে এক মহৎ ধর্মোপদেশ দেন। তিনি বলেন, “এই পৃথিবীর সর্বোত্তম ধর্ম হল নিজের কর্তব্য পালন করা।” একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুনের কর্তব্য হল যুদ্ধ করা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে, তার কর্ম যদি ন্যায়ের জন্য হয় এবং ঈশ্বরের নামে হয়, তবে তা কখনোই পাপের সমতুল্য হতে পারে না।
ধর্মযুদ্ধ: প্রাচীন ভারতীয় কাহিনি
ধর্ম ও কর্তব্যের এই দ্বন্দ্বটি প্রাচীন ভারতীয় গল্পগুলোতেও বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন, মহাভারতের একজন উল্লেখযোগ্য চরিত্র ভীষ্ম। ভীষ্ম পিতামহও ঠিক একইরকম দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি কৌরবদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কারণ তার কর্তব্য ছিল তার রাজাকে সেবা করা। তিনি জানতেন যে তিনি অনৈতিক পক্ষে, কিন্তু একজন বিশ্বস্ত যোদ্ধা হিসেবে কর্তব্যের প্রতি তার অটলতা তাকে সবার শ্রদ্ধাভাজন করেছিল।
অর্জুনের ক্ষেত্রেও এই একই শিক্ষা প্রযোজ্য। তার দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়ে প্রশ্ন আসে—“কীভাবে আমি নিজের রক্তকে হত্যা করব?” শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেন, তোমার কর্তব্যই তোমার ধর্ম এবং ধর্মই তোমার পরম জীবনপথ।
শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ এবং আমাদের জীবনে এর প্রয়োগ
এই উপদেশের একটি চমৎকার প্রয়োগ হতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। চলুন দেখা যাক কিভাবে:
- নিজের দায়িত্ব পালন: আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন আমরা কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। কিন্তু সেই সময় যদি আমরা ন্যায়ের পথে থাকি এবং সত্যের সাথে থাকি, তবে আমাদের হৃদয়ে কোনো পাপবোধ থাকবে না।
- কর্মে সমতা বজায় রাখা: আমরা প্রায়ই নিজস্ব আবেগ এবং সম্পর্কের কারণে আমাদের ধর্ম বা কর্তব্য থেকে দূরে সরে যাই। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে আমাদের উচিত আমাদের নিজ কর্তব্যে অবিচল থাকা, এবং কোনো লোভ বা বন্ধনের মোহে না পড়া।
- বিচার ও ন্যায়ের পথে থাকা: যদি আমাদের সিদ্ধান্ত ন্যায়ের জন্য হয়, তবে সেই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের কোনো অনুশোচনা অনুভব করার প্রয়োজন নেই।
শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনের শিক্ষা
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই বিশেষ অংশটি আমাদের জীবনের এক অনন্য শিক্ষা দেয়—কিভাবে ধর্ম এবং কর্তব্য পালনে আমরা একনিষ্ঠ হতে পারি। আত্মীয়স্বজনের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, জীবনের এক বিশেষ সময়ে ন্যায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে হবে।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে:
- ধর্ম কখনো পক্ষপাতদুষ্ট নয়।
- ধর্ম ও কর্তব্য কখনো প্রিয়জনের জন্য অবহেলা করা উচিত নয়।
- সত্যের পথে থাকা ন্যায়ের পথে থাকাই ধর্মের পথ।
কেন এই শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক?
বর্তমান যুগেও আমরা অনেক সময় ন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে সংকটে পড়ি, প্রিয়জনকে আঘাত দিতে হয়। তখন আমাদের মনে পাপবোধ আসে, যেমনটি অর্জুনের হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ এই সব ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এক বিশেষ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন, “সত্য কখনো পাপের সাথে থাকতে পারে না।”
শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যের সারমর্ম
এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের জানাচ্ছেন যে,
- ন্যায় প্রতিষ্ঠা হল পরম ধর্ম: যখনই আমরা ন্যায়ের জন্য কাজ করি, তখন আমাদের মন সব সময় শুদ্ধ থাকে।
- সত্যের সাথে থাকা পাপকে জয় করা: সত্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করলে, সব পাপ এবং পাপের ভয় দূর হয়ে যায়।
- কর্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া: আমাদের জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে কর্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, ঠিক যেমন অর্জুন করেছিলেন।
এই শ্লোকটি আমাদের শিখায় কিভাবে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে, আত্মীয়স্বজনের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও নিজের কর্তব্য পালন করতে হয়। জীবন থেকে জটিলতা দূর করতে, আমাদের সব সময় কর্তব্য এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকতে হবে, এবং শ্রীকৃষ্ণের মতো মহান আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোকের শিক্ষা যদি আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তবে জীবন থেকে সব দ্বিধা, পাপবোধ এবং সংকোচ দূর হয়ে যাবে, এবং আমরা এক সুখী ও সৎ জীবন যাপন করতে পারব।