যদ্যপেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ ॥৩৭॥
ভগবদ্গীতার এই শ্লোকটি আমাদের জীবন চলার পথের একটি গভীর সতর্কবার্তা। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে অর্জুনের সামনে যুদ্ধের বেদনাদায়ক পরিণতি স্পষ্ট হলেও তিনি সংশয়ে পড়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন, যখন আমাদের মন লোভে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন আমরা ভুল এবং অশুভ কাজের পরিণতি বুঝতে ব্যর্থ হই।
আপনি কি কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন যেখানে লোভ বা স্বার্থপরতা আপনার সঠিক বিচারশক্তিকে অবদমিত করেছে? আমি নিজেও এমন অনেক সময়ের মুখোমুখি হয়েছি যখন আবেগের বশে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। গীতার এই শিক্ষাগুলোই আমাকে পথ দেখিয়েছে। চলুন আজ আমরা আলোচনা করি কিভাবে লোভ আমাদের জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং গীতা কীভাবে আমাদের সঠিক পথ দেখায়।
লোভ আমাদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে?
১. সম্পর্কের অবনতি:
ভগবদ্গীতা বলে, “লোভ থেকে কাম, কাম থেকে ক্রোধ এবং ক্রোধ থেকে বিভ্রান্তি জন্মায়।” (২:৬৩)
ধরুন, আপনি একটি ব্যবসা করছেন এবং শুধুমাত্র লাভের কথা চিন্তা করে নৈতিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখলেন। হয়তো প্রাথমিকভাবে আপনি সাফল্য পেলেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বিশ্বাসঘাতকতার মতো হবে। এমনটাই দেখা যায় যে, লোভের কারণে অনেক ব্যবসায়ী বা কর্মচারী নিজেদের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের বিশ্বাস হারায়।
২. অন্যের ক্ষতি করা:
অনেক সময় লোভ আমাদের এমন কাজে প্ররোচিত করে যা অন্যের ক্ষতি করে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেন, “যে ব্যক্তি অন্যের অধিকারকে হরণ করে, সে সর্বনাশের পথে যায়।”
উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আমরা নিজের সুবিধার জন্য অফিসে কাজের ক্রেডিট অন্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিই। এতে সাময়িক লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব এবং সম্মান ধ্বংস হয়।
৩. পরিবেশ এবং সমাজের ক্ষতি:
লোভের একটি বাস্তব উদাহরণ হলো প্রকৃতির প্রতি আমাদের অবহেলা। উন্নয়ন এবং আর্থিক লাভের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা গাছ কাটছি, নদী দূষিত করছি। এ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে চললে তার ফল মানবজাতিকে ভোগ করতে হবে।”
গীতা কীভাবে আমাদের পথ দেখায়?
১. ত্যাগ এবং ন্যায়ের পথে চলা:
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, “তোমার কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু ফলের প্রতি তোমার কোনো অধিকার নেই।”
আপনি যদি নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন এবং লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন, তাহলে জীবনে শান্তি পাবেন। এটি বাস্তব জীবনে এমন যে, একজন শিক্ষক যদি শুধুমাত্র ভালো ফলের আশায় না থেকে শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের শেখার দিকে মনোনিবেশ করেন, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই।
২. আত্মসংযম এবং যোগের পথ:
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ব্যক্তি প্রকৃত শান্তি লাভ করে।”
যদি আমরা আমাদের লোভ ও কামনাকে সংযত করতে পারি, তাহলে আমাদের মন শান্ত ও সুষম থাকবে। আপনি যদি আপনার প্রয়োজন এবং চাহিদার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন, তাহলে জীবনের অনেক সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান হয়ে যাবে।
৩. নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
ভগবদ্গীতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যখন আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি শুধু নিজের স্বার্থে নয়, বৃহত্তর সমাজ এবং পরিবারের কল্যাণের জন্যও হওয়া উচিত।
প্রতিদিনের জীবনে গীতার শিক্ষা প্রয়োগ
১. নিজের কর্মে সততা বজায় রাখুন।
লোভ এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো সততার সাথে কাজ করা। আপনি যদি অফিসে বা ব্যবসায় লোভের পথে না গিয়ে সৎ পথে চলেন, দীর্ঘমেয়াদে আপনি মানসিক শান্তি পাবেন।
২. আত্মবিশ্বাস বাড়ান।
অনেক সময় আমরা ভাবি, ‘আমি যদি অন্যকে ঠকাই না, তাহলে তো আমি পিছিয়ে পড়ব।’ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিক্ষা দেন, প্রকৃতির নিয়মে ন্যায়ের পথে চললে তুমি কখনো হেরে যাবে না।
৩. ইন্দ্রিয় সংযম চর্চা করুন।
প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান এবং আত্মচিন্তার জন্য রাখুন। এটি আপনাকে আপনার লোভ এবং কামনা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।
উপসংহার: আপনি কীভাবে নিজের জীবনকে গীতা অনুযায়ী সাজাবেন?
আমরা প্রতিদিন জীবনের দৌড়ে এতটাই ব্যস্ত যে, কখনো কখনো ভুল পথে চলে যাই। কিন্তু গীতার শিক্ষা আমাদের সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনে। লোভ থেকে মুক্তি পেলে আমরা কেবল নিজের জীবনকেই সুন্দর করতে পারি না, বরং সমাজকেও বদলে দিতে পারি।
আজকের দিন থেকেই কি আমরা এই শপথ নিতে পারি না যে, আমরা আমাদের লোভের দাস হব না? আপনার জীবনে এমন কোন সমস্যা আছে যা গীতার শিক্ষার সাহায্যে সমাধান করা যেতে পারে? ভাবুন এবং সিদ্ধান্ত নিন, আপনি কীভাবে জীবনের সত্য পথে চলবেন।
“ভালোবাসা এবং সত্যের পথে চললে জীবনের সব চ্যালেঞ্জই সহজ হয়ে যাবে। আপনি কোন পথে হাঁটবেন?”
আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না! আশা করি এই লেখা আপনাকে গীতার অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলো জীবনে প্রয়োগ করতে অনুপ্রাণিত করবে।
জয় শ্রীকৃষ্ণ!