১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৩৯

১.৩৯ঃ পারিবারিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য?

“কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।

ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত ॥৩৯॥”

শ্রীমদ্ভগবদগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই শ্লোকটি বলা হয়েছে। এ শ্লোকটির মাধ্যমে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্জুনকে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কুলক্ষয় বা বংশের ধ্বংসের ফলে সনাতন ধর্মের মূল্যবোধ এবং নিয়মগুলি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। এই বিলুপ্তির মাধ্যমে আসে অধর্মের প্রভাব এবং সমাজে নেমে আসে বিপর্যয়।

 শ্লোকটির প্রেক্ষাপট: কুরুক্ষেত্রের দ্বন্দ্ব

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যখন তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধে কুলের ধ্বংস হলে কুলধর্ম নষ্ট হয় এবং এর ফলে ধর্মের ভিত্তি দুর্বল হয়। একবার ধর্ম হারিয়ে গেলে, অধর্ম শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সমাজে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

 কুলধর্ম ও সনাতন ধর্ম: পারিবারিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য

  •  কুলধর্মের সংজ্ঞা: কুলধর্ম বলতে বোঝানো হয় এক একটি পরিবারের নিজস্ব আচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। 
  •  সনাতন ধর্ম: এটি সময়ের ঊর্ধ্বে এবং সর্বজনীন, যার মূল লক্ষ্য হলো ধর্ম, সততা, দায়িত্বশীলতা ও সেবামূলক কাজ।

 কুলধর্মের গুরুত্ব এবং তার সংরক্ষণ

কুলধর্মের ধারণা শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। সমাজের প্রতিটি পরিবার যদি তাদের ধর্ম ও দায়িত্ববোধকে ধরে রাখতে পারে, তবে সমাজও সুসংহত থাকে।  

কেন কুলধর্মের সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ?

  •  কুলধর্ম পরিবারে নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করে।
  •  ধর্মের সংরক্ষণ সমাজে স্থিতি এবং শান্তির পরিবেশ তৈরি করে।
  •  কুলধর্মের লোপ হলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে।

 ধর্মের লোপ ও অধর্মের প্রবেশ: কুলক্ষয়ের ফলাফল

যখন একটি পরিবারে কুলধর্ম ধ্বংস হয়, তখন সেখানে অসৎ এবং আদর্শহীন প্রথার আবির্ভাব ঘটে। এই প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং অধর্মকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে।

কুলক্ষয়ের কিছু প্রতিফলন:

  •  পরিবারে শিষ্টাচারের অভাব
  •  প্রজন্মের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব
  •  সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি

 ধর্মের শিক্ষা: একটি শিক্ষণীয় গল্প

একবার এক পন্ডিত ব্রাহ্মণ ছিলেন, যিনি তার পুত্রকে ধর্মের মূল শিক্ষাগুলি দিয়েছিলেন। পুত্রটি বড় হলে এক সময় ধর্মকে মূল্যহীন মনে করতে শুরু করেছিল এবং পারিবারিক ঐতিহ্য অবহেলা করতে লাগল। একদিন, তার পরিবারে বড় এক বিপর্যয় এল, এবং তখন সে বুঝতে পারল পারিবারিক ধর্ম এবং ঐতিহ্যের গুরুত্ব। সে পুনরায় কুলধর্মকে গ্রহণ করল এবং ধীরে ধীরে তার পরিবারে শান্তি ও সুখ ফিরে এল।

এই গল্পটি আমাদের দেখায় যে কুলধর্মকে অবহেলা করলে কীভাবে পরিবার ও সমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

 কুলক্ষয় এড়ানোর জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

  •  পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা:  

সন্তানদের ছোট থেকেই পারিবারিক ধর্মীয় শিক্ষায় গড়ে তোলা উচিত। এতে তারা পারিবারিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে সম্মান করতে শিখবে।

  • নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন:  

পারিবারিক পরিবেশে নিয়মিত ধর্মীয় অনুশীলন এবং আচার অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়।

  •  বড়দের সান্নিধ্যে শিশুদের রাখা:  

বড়দের সঙ্গ পাওয়া মানে সন্তানরা মূল্যবোধের শিক্ষা পায়। এতে তাদের চরিত্রে পুণ্যের সংমিশ্রণ ঘটে।

  •  দায়িত্বশীল আচরণ:  

পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের উচিত নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। এই দায়িত্বশীল আচরণই ধর্মের অন্যতম শিক্ষা।

 কুলক্ষয় প্রতিরোধের দায়িত্ব আমাদের

কুলক্ষয় হলে কুলধর্ম বিলুপ্ত হয় এবং এর ফলে অধর্মের প্রবেশ ঘটে। এটি আমাদের দায়িত্ব যে আমরা নিজেরা এবং আমাদের প্রজন্ম কুলধর্মের মূল মর্মার্থ বুঝে পালন করব। সনাতন ধর্মের আদর্শকে ধারন ও অনুসরণ করার মধ্যেই শান্তি, স্থিতি এবং সার্থক জীবনের পথ নিহিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top