১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৪০

১.৪০ঃ  কুলধর্ম ও নারীদের ভূমিকা?

হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ তার শিষ্য অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জীবনদর্শন ও ধর্মীয় উপদেশ দেন। গীতার ১ম অধ্যায়ের ৪০তম শ্লোকটি আমাদের এক মহত্তম দর্শনের দিকে নিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকে সমাজের অধর্ম, কুলধর্ম ও নারীদের আচারআচরণ নিয়ে গভীর মন্তব্য করেছেন। আসুন এই শ্লোকটি বিশ্লেষণ করি এবং বুঝে নেই অধর্ম কিভাবে সমাজকে দূষিত করে এবং তার প্রভাবে কুলধর্ম ও নারীদের ভূমিকা কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।

 শ্লোকটির অর্থ ও বিশ্লেষণ

“অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রীয়ঃ।  

স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ॥”

  •  অর্থ: শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “হে কৃষ্ণ, অধর্মের প্রভাবে কুলের নারীরা দূষিত হয়ে পড়ে। যখন নারীরা অধর্মে প্রভাবিত হয়, তখন সমাজে বর্ণসংকর প্রজন্মের উৎপত্তি ঘটে।”

এই শ্লোকের মূল ভাবনাটি হল, যদি অধর্ম কুলের মধ্যে প্রবেশ করে, তবে কুলের নারীরা দূষিত হয়ে যায়। নারীরা যখন তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তাদের চরিত্রে ও আচারব্যবহারে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সমাজে জন্মায় বর্ণসংকর বা ধর্মভ্রষ্ট প্রজন্ম, যা সমাজের শৃঙ্খলা এবং সঠিক ধর্মীয় জীবনযাত্রায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

 কুলধর্ম ও নারীদের ভূমিকা

প্রাচীন হিন্দু সমাজে কুলধর্ম বা কুলের নীতিগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এতে বলা হয়েছিল যে, একটি পরিবার বা কুলের শুদ্ধতাই সমাজকে স্থিতিশীল করে রাখে। সেই সমাজের নারীরা ছিলেন কুলের ধর্ম বা নৈতিকতার ধারক এবং বাহক।

  •  কুলের নারীরা তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতেন।
  •  তারা পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় আচার ও সংস্কার বজায় রাখতেন।
  •  নারীরা কুলের মর্যাদা রক্ষা করে সেই কুলের ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতেন।

কিন্তু যদি অধর্ম কুলের মধ্যে প্রবেশ করে, নারীদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা এবং নৈতিকতায় অবক্ষয় দেখা দেয়। ফলে তারা ভুল পথে চালিত হতে পারেন, যার মাধ্যমে সমাজে এক ধরনের বিশৃঙ্খল এবং অসংহত প্রজন্মের সৃষ্টি হয়। এই প্রজন্মকে বর্ণসংকর বলা হয়, যারা নিজেদের কুলের এবং ধর্মীয় মূল থেকে বিচ্যুত হয়।

 শ্রীকৃষ্ণের বার্তা ও আমাদের বর্তমান সমাজ

শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যের একটি দিক হলো—যদি অধর্ম কুলে প্রবেশ করে, তবে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, এবং তাদের মধ্য দিয়ে সমাজেও সেই ক্ষতির সঞ্চার হয়। বর্তমান সমাজেও এ বার্তাটি প্রযোজ্য। আজকাল সমাজে বিভিন্ন আধুনিকতাবাদী এবং বাণিজ্যিক চাপে আমাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় নীতিতে অবক্ষয় ঘটছে। 

  •  নৈতিক শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে।
  •  পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির অভাব দেখা দিচ্ছে।
  •  অধর্ম বা দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে।

 ধর্মীয় গল্প: সতী সীতার উদাহরণ

হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রগুলোতে সতী সীতার কাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সীতা দেবী ছিলেন এক উচ্চ কুলের নারী এবং তার চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও নীতিবদ্ধ। তার জীবন আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে একজন নারী তার কুলের মর্যাদা বজায় রাখার জন্য নিজেদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয়। 

রামের বনবাসকালে সীতা তাকে অনুসরণ করেছিলেন, এবং যখন রাবণ তাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়, সীতা তার সতীত্ব ও নীতির প্রতি অবিচল ছিলেন। সীতার কাহিনী আমাদের শিখিয়েছে যে কুলধর্ম বজায় রাখার জন্য একজন নারীর চরিত্র এবং ধর্মবিশ্বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

 বর্ণসংকর কী এবং কেন এটি ক্ষতিকর?

বর্ণসংকর বলতে বোঝায় সেই প্রজন্ম যারা তাদের ধর্মীয় এবং কুলগত চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়। এই প্রজন্ম সমাজের জন্য ক্ষতিকর, কারণ তারা আদর্শহীন হয়ে ওঠে এবং ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে।

বর্ণসংকরের ক্ষতিকারক দিকগুলি:

  •  সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
  •  ধর্মীয় এবং নৈতিক আচারআচরণ ভুলে যায়।
  •  পরিবারের মূল্যবোধ হারিয়ে যায় এবং এক ধরনের স্বার্থপর জীবনযাপন করে।

 কীভাবে ধর্ম এবং সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব?

আমাদের কুলধর্মকে রক্ষা করতে হলে এবং অধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হলে, শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করতে হবে:

  •  নৈতিক শিক্ষা প্রদান: ছোট থেকেই শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা সঠিকভুলের পার্থক্য বুঝতে শেখে।
  •  ধর্মীয় আচারআচরণ পালন: পরিবারের মধ্যে নিয়মিত পূজা, হোমযজ্ঞ ইত্যাদি ধর্মীয় আচার পালনে সক্রিয় হতে হবে।
  •  সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা: আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের সচেতন করতে হবে।

 শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা অনুসরণ করা

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিখিয়েছেন যে, ধর্মই সমাজের মেরুদণ্ড। আমাদের উচিত তার শিক্ষার অনুসরণ করে আমাদের জীবনে এবং সমাজে ধর্মের শুদ্ধতা বজায় রাখা। এর মাধ্যমেই আমরা কুলধর্ম রক্ষা করতে পারব এবং বর্ণসংকর প্রজন্মের সৃষ্টি প্রতিরোধ করতে পারব।

অতএব, শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top