১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৪২

১.৪২ঃ বর্ণসঙ্কর কি?

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে, শ্লোক ৪২এ (যা চতুর্থ অধ্যায়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন  কুলধর্মের অধঃপতন এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ণসঙ্কর সমস্যা। আসুন আজ এই শ্লোকটির তাৎপর্য, প্রভাব, এবং কিছু পৌরাণিক কাহিনি দিয়ে বিষয়টি সহজবোধ্য করে বিশ্লেষণ করি।

 শ্লোকের বাণী: দোষ এবং অধঃপতন

“দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ |  

উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ||”

 শ্লোকের অর্থ:

এই শ্লোকে বলা হয়েছে, যে সকল দোষ কুল বা পরিবারের পতনের কারণ হয়, সেই সমস্ত দোষের কারণে বর্ণসঙ্কর বা বর্ণভ্রষ্টতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে, কুল বা গোত্রের পবিত্র ধর্মগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়। 

এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সমাজের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন। আমাদের বংশের বা কুলের যে ধর্ম এবং আদর্শ, তা আমাদের সংস্কৃতি এবং সমাজের মূল স্তম্ভ। এই শাশ্বত কুলধর্মের অধঃপতন ঘটলে সমাজের শৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

 কুলধর্ম এবং বর্ণসঙ্কর: কি বোঝানো হয়েছে?

প্রাচীন হিন্দু সমাজে চারটি বর্ণ বা সমাজের স্তর ছিল  ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। প্রতিটি বর্ণের নিজস্ব কর্ম এবং ধর্ম ছিল, যা শাস্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত। বর্ণসঙ্কর বলতে বোঝানো হয়েছে, এই বর্ণের মাঝে এক প্রকার মিশ্রণ বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়া, যা সঠিক সমাজব্যবস্থা এবং ধর্মীয় অনুশাসনের পথকে বিঘ্নিত করে। 

 কুলধর্ম কী?

  •  এটি একটি পরিবারের মূলনীতি এবং ধর্মীয় রীতিনীতির সমষ্টি
  •  বংশানুক্রমে পিতামাতার থেকে সন্তানদের মধ্যে পরম্পরায় আসে
  •  পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্বে অবিচল থাকা, বংশের মান রক্ষা করা এবং নৈতিকতাকে মূল্য দেওয়া 

 বর্ণসঙ্কর কেন সমস্যার সৃষ্টি করে?

  •  চারটি বর্ণের মধ্যে প্রতিটি বর্ণের আলাদা ধর্ম এবং দায়িত্ব আছে। 
  •  এই দায়িত্বগুলি যদি পরিপূর্ণভাবে পালন করা না হয়, তবে সামাজিক এবং ধর্মীয় ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
  •  যার ফলে, কুলধর্মের পবিত্রতা হারিয়ে যায় এবং সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলার জন্ম হয়।

 পৌরাণিক কাহিনি: কুলধর্ম রক্ষা ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা

একটি প্রাচীন কাহিনি আমাদের কুলধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শিক্ষা দেয়। মহাভারতে, ভীষ্ম পিতামহ কুরুবংশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সবসময় কুলধর্ম এবং জাতিধর্ম রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়, ভীষ্ম নিজেই ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি জানতেন, ধর্মের লঙ্ঘন করলে কুলধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বর্ণসঙ্করের সৃষ্টি হবে। তাঁর এই মহান ত্যাগের উদাহরণ আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, কুলধর্ম রক্ষা করা কেমন গুরুত্বপূর্ণ।

 বর্তমান যুগে কুলধর্ম এবং বর্ণসঙ্কর

আজকের দিনে এই শাশ্বত ধারাগুলিকে মেনে চলা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যিকারের কুলধর্মের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে সুশৃঙ্খলতা এবং ধর্মীয় অনুভূতি বজায় রাখা যায়। 

 আমরা কিভাবে কুলধর্মকে রক্ষা করতে পারি?

  •  পারিবারিক মান এবং ঐতিহ্য রক্ষা করা: শিশুদের মধ্যে কুলধর্ম এবং পবিত্র রীতিগুলির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
  •  শাস্ত্রের চর্চা: ধর্মীয় গ্রন্থ পড়া, এবং তার মধ্যে থেকে জীবনযাপন এবং ধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধি করা।
  •  নৈতিকতার শিক্ষা: নিজের পরিবার এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া।

 কীভাবে বর্ণসঙ্কর এড়ানো যায়?

সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এবং কুলধর্মের পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আমাদের কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে:

  •  ধর্মের মূলনীতির চর্চা এবং পালন
  •  শাস্ত্রের উপদেশ মেনে চলা
  •  পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্বকে গুরুত্ব দেওয়া

 কুলধর্ম রক্ষা এবং ধর্মীয় অগ্রগতি

শ্রীকৃষ্ণ এখানে এই শিক্ষাটিই দিয়েছেন যে, কুলধর্ম এবং জাতিধর্ম একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। আমাদের ধর্মীয় পরিচয় এবং পবিত্রতা বজায় রাখতে হলে, পারিবারিক দায়িত্ব এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে মেনে চলতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top