১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৪৩

১.৪৩ঃ  কুলধর্ম কী?

ধর্ম কেবলমাত্র উপাসনা বা নিয়ম পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানবজীবনের এক অভ্যন্তরীণ শক্তি, যা পরিবার এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১ম অধ্যায়, ৪৩তম শ্লোক) অত্যন্ত গভীরভাবে মানবজীবনের এই দিকটি বর্ণিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ আছে যে, যখন এক কুলের ধর্ম ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে এবং মানুষ নরকের শাস্তির মুখোমুখি হয়। 

 শ্লোকটির অর্থ ও বিশ্লেষণ

“উৎসন্ন কুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন |  

নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ||”

এই শ্লোকে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে ‘জনার্দন’ অর্থাৎ ‘সকলের হৃদয়ধারক’ হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন যে, এক কুলের ধর্ম যখন লোপ পায়, তখন সেই কুলের লোকেরা নৈতিক অবক্ষয়ে পতিত হয়ে নরকগামী হয়। অর্জুন এই শ্লোকে খুব সজাগভাবে পরিবারের, কুলধর্মের এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। 

 কুলধর্ম কী?

‘কুলধর্ম’ শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয় এক কুল বা পরিবারের মূল্যবোধ, ধর্মাচরণ, আচারঅনুষ্ঠান, এবং প্রাচীন প্রথা। এই কুলধর্মই আমাদের সংস্কৃতির ভিতকে শক্তিশালী করে এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে।

  •  কুলধর্ম হলো পরিবারের আদি শিক্ষার মূল ভিত্তি।
  •  এটি মানসিক প্রশান্তি এবং শান্তির জন্য অপরিহার্য।
  •  পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে।

 কেন কুলধর্ম গুরুত্বপূর্ণ?

হিন্দু ধর্মে পরিবারকে এক ধরনের আশ্রয় হিসেবে দেখা হয়, যেখানে সব ধরনের আত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা স্থান পায়। পরিবারের মধ্যে যদি ধর্মীয় আচারআচরণ লোপ পায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম সঠিক শিক্ষার অভাবে তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। এভাবে এক সময় সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং মানব সমাজের অবনতি ঘটে।

 শাস্ত্রীয় কাহিনী: পিতামহ ভীষ্মের উদাহরণ

মহাভারতে আমরা দেখেছি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে ভীষ্ম পিতামহ এক গুরুতর প্রশ্নের মুখোমুখি হন। ভীষ্ম কুলের ধর্ম রক্ষা করতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, ধর্ম রক্ষায় কুলের যোদ্ধাদের নির্দেশিত পথে চালিত করতে হবে, তবে নিজের পরিবারের যোদ্ধাদের মঙ্গল চিন্তা করাও তাঁর দায়িত্ব। এর মাধ্যমে তিনি ‘কুলধর্ম’ রক্ষা করে ধর্মের পথে অবিচল থেকেছেন। 

 বর্তমান প্রেক্ষাপটে কুলধর্মের প্রয়োগ

আজকের সমাজে আমরা অনেকেই পারিবারিক ঐতিহ্য ও আচারআচরণ থেকে দূরে সরে গেছি। একদিকে প্রযুক্তি আমাদের সুবিধা এনে দিচ্ছে, অন্যদিকে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়ও বাড়ছে। এ কারণেই এখন কুলধর্ম ও পারিবারিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করা জরুরি। আমরা যদি নিজেদের ধর্মীয় এবং পারিবারিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি, তাহলে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় থাকে। 

 পরিবারে ধর্মচর্চা: কিভাবে করা যায়?

পরিবারে কুলধর্মকে বজায় রাখার জন্য নিচের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

  •  দৈনন্দিন প্রার্থনা: পরিবারের সবাই মিলে প্রতিদিন প্রার্থনা করা।
  •  শাস্ত্র পাঠ: গীতা, রামায়ণ, মহাভারত পাঠের মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা।
  •  ধর্মীয় উৎসব পালন: ধর্মীয় উৎসবগুলি একসঙ্গে পালনের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে দৃঢ় করা।
  •  প্রতিদিনের ছোট ছোট কর্ম: সৎকর্ম, সহানুভূতি এবং মানবসেবার শিক্ষা বাড়িতে শুরু করতে হবে। 

 কুলধর্ম হারালে কী ক্ষতি হতে পারে?

কুলধর্মের অনুপস্থিতি পারিবারিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির বিনাশ ঘটায়, যা পরবর্তী প্রজন্মের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। পরিণামে, সমাজের মানুষ নৈতিক অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অন্যায়পথে চালিত হয়ে যায়, যা তাদের এবং সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

 ধর্ম রক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধের জন্য পরামর্শ

  •  সংস্কৃতির জ্ঞান প্রদান: পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের দায়িত্ব, তারা যেন নবীনদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন।
  •  সৎকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানো: পরিবারে সৎকর্ম ও সচ্চরিত্র গঠনের প্রতি জোর দিতে হবে।
  •  ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা: শাস্ত্র ও ধর্মীয় পুস্তকগুলির পাঠ পরিবারের মধ্যে নিয়মিত করা।

  ধর্মীয় মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ধর্ম রক্ষায় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুলধর্ম যদি রক্ষা না করা যায়, তবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই বিপর্যয় নেমে আসে। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের কথোপকথন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ধর্মীয় এবং পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষা করাই আমাদের জীবনের এক অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top