১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৪৪

২.৪৪ঃ স্বজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যাবসিতা বয়ম্ ।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ॥

অর্থ: “হায়! কী মহাপাপের জন্য আমরা উদ্যত হয়েছি! রাজ্য ও সুখের লোভে স্বজনদের বিনাশ করতে চলেছি।”

জীবনের যেকোনো সময়ে আমাদের সামনে এমন পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায়, যেখানে আমাদের নিজস্ব লাভ বা স্বার্থের জন্য আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যা শেষমেশ আমাদের কাছের মানুষদের ক্ষতি করে। এমনকি পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীদের প্রতি অবিচারও করে বসি। আজকের সমাজে লোভ, ঈর্ষা এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে আত্মোপলব্ধি ছাড়া মুক্তির আর কোনো পথ থাকে না। এই শ্লোকটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়, কতবার নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের হৃদয়ে যন্ত্রণা তৈরি হয়।

গীতার শিক্ষা: তুমি লোভের দাস নও

ভগবদ্গীতার প্রতিটি অধ্যায় জীবনের জন্য একটি গাইডলাইন। এই শ্লোকটি মূলত কৌরব-পাণ্ডব যুদ্ধের আগে অর্জুনের মুখ থেকে উচ্চারিত। অর্জুন উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে চলেছেন শুধুমাত্র রাজ্য এবং ক্ষমতার লোভে। কিন্তু আমাদের জীবনে কি এমন হয় না?

আমি নিজেই বহুবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যেখানে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অন্যদের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছি। হোক সেটা অফিসে সহকর্মীর প্রাপ্য সম্মান কেড়ে নেওয়া, অথবা পরিবারের মধ্যে একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করা।

গীতার একটি শিক্ষা হলো:
“লোভ মানুষের সত্যিকারের সুখ কেড়ে নেয় এবং তাকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।”

বাস্তব জীবনের উদাহরণ: ভুল সিদ্ধান্তের ফলাফল

চলুন কয়েকটি সাধারণ সমস্যার কথা বলি, যা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রাসঙ্গিক:

১. পারিবারিক কলহের কারণ

অনেক সময় পরিবারের সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। ছোটখাটো সম্পত্তির লোভে ভাই-বোনেরা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। একবার আমার পরিচিত এক বন্ধুর পরিবারে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ এতটাই বেড়ে গেল যে আদালতে মামলা করতে হলো। পরে তারা বুঝতে পারলো, সম্পর্কের মূল্য সম্পত্তির থেকে অনেক বেশি। গীতার শিক্ষা তাঁদের জীবনে ফিরিয়ে আনলো:

“সুখ ও শান্তি তখনই আসে যখন তুমি নিজের ইচ্ছা, লোভ, এবং অহংকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো।”

২. কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা

একটি বড় কোম্পানিতে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, অনেক সহকর্মী নিজেদের প্রোমোশনের জন্য অন্যের কাজের কৃতিত্ব নিতে পিছপা হন না। কিন্তু গীতা বলে:

“তোমার কাজ করো, ফলের আশায় লোভ করো না।”
কর্মক্ষেত্রে আমাদের উচিত শুধু নিজের দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, অন্যদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা। যে ব্যক্তি সত্যিকারের যোগ্য, তিনি সময়মতো স্বীকৃতি পাবেনই।

৩. বন্ধুত্বে বিশ্বাসঘাতকতা


বন্ধুত্ব একটি পবিত্র সম্পর্ক। কিন্তু কখনো কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। একবার একজন বন্ধুকে বিশ্বাস করে আমি একটি কাজ করেছিলাম। পরবর্তীতে বুঝেছিলাম, সেই কাজের সুযোগ নিয়ে সে নিজের লাভের জন্য আমাকে ঠকিয়েছে। গীতার শিক্ষা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল:

“ধর্মের পথ ছেড়ে অন্যায় পথে হাঁটলে স্বল্পমেয়াদি লাভ হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তার ফল ভয়াবহ।”

৪. ইগো ও অহংকারের কারণে সম্পর্ক নষ্ট:

আমাদের অহংকার অনেক সময় সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে। আমরা ভুল স্বীকার করতে চাই না, দোষারোপ করি অন্যকে। কিন্তু গীতা বলে:

“অহংকার ত্যাগ করো, কারণ সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু।”
একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। এক দম্পতির মধ্যে তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল। কেউই প্রথমে ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না। দিন গড়িয়ে মাস পার হয়ে গেল। পরে তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ইগো তাদের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল।

গীতা আমাদের কী শেখায়?

ভগবদ্গীতার শিক্ষা খুবই স্পষ্ট – জীবনে সত্য ও ধর্মের পথে চলাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। অর্জুনের মতো আমাদেরও নিজেদের ভুল বুঝতে হবে এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এখানে তুলে ধরি:

১. “কর্ম করো, ফলের চিন্তা করো না।”
জীবনের যেকোনো কাজের ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে সৎভাবে কাজ করো।

২. “লোভ, ক্রোধ এবং আসক্তি থেকে দূরে থাকো।”
এই তিনটি জিনিস জীবনের শান্তি নষ্ট করে।

৩. “নিজের কর্তব্য পালন করো, কিন্তু অন্যের কাজের প্রতি হিংসা করো না।”

৪. “সত্যের পথে অটল থাকো, কারণ ধর্মই তোমাকে মুক্তি দেবে।”

তুমি কীভাবে গীতার শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করতে পারো?

১. দিনে অন্তত ১০ মিনিট গীতা পাঠ করো। এতে মন শান্ত হবে এবং আত্মোপলব্ধি বাড়বে।
২. নিজের সিদ্ধান্তের আগে একবার ভেবে দেখো, সেটি কী সত্যিই সবার মঙ্গলের জন্য।
৩. লোভ, ক্রোধ বা অহংকার যখনই আসবে, নিজেকে থামিয়ে বলো – “আমি এর দাস নই।”
৪. জীবনের ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে চিন্তা না করে বড় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাও।

গীতার আলোকে জীবনের পথে

জীবনের যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা যদি গীতার শিক্ষাকে মনে রাখি, তাহলে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারব।

তুমি কি কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছো, যেখানে লোভ বা ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা তোমাকে ভুল পথে চালিত করেছে? ভাবো, সেই মুহূর্তে গীতার শিক্ষা তোমাকে কীভাবে পথ দেখাতে পারতো।

শেষে বলি:
“জীবন হলো একটি যুদ্ধক্ষেত্র, কিন্তু সত্য ও ধর্মের পথে থেকে তুমি এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে। তুমি কী সত্যের পথে এগিয়ে যাবে?”

আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না। গীতার শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে আলো হয়ে উঠুক!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top