যদি মামপ্রতিকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ॥৪৫॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৪৫তম শ্লোকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং মানব জীবনের চিরন্তন জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে আসে। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের মানসিক দ্বন্দ্ব এবং তার নৈতিক সংকটের সময়ে এই শ্লোকটি উঠে আসে।
এই শ্লোকটি শুধু অর্জুনের ব্যক্তিগত কাহিনী নয়, এটি আমাদের নিজেদের নৈতিকতা, সহিংসতা, এবং পরিত্রাণের মানসিকতার মধ্যেও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
আজকের আলোচনায়, আমরা এই শ্লোকের ভাবার্থ, এর নৈতিক শিক্ষা, এবং এর সাথে একটি প্রাচীন হিন্দু গল্পকে জুড়ে দেব যা এই শ্লোকের দর্শনকে আরো স্পষ্ট করে তুলবে।
শ্লোকটির অর্থ
এই শ্লোকের মর্মার্থ নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। এখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন:
“যদি কৌরবরা অস্ত্রহীন, প্রতিরোধহীন আমাকে হত্যা করে, তাহলে আমার জন্য সেটাই উত্তম হবে।”
অর্জুন এখানে বলতে চাচ্ছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্যে সে যদি অস্ত্র না তোলে এবং তার আত্মীয়স্বজনদের হাতে মারা যায়, তবেই তার জন্য সেটি কল্যাণকর হবে।
কেন অর্জুন অস্ত্র তোলেন না?
অর্জুনের এই মনোভাবের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে যা আমরা বিবেচনা করতে পারি:
- পারিবারিক সম্পর্ক: কৌরবরা তার আত্মীয়। যুদ্ধে নিজের রক্তের সাথে যুদ্ধ করতে চাওয়া অস্বাভাবিক।
- নৈতিক দ্বন্দ্ব: হিন্দু ধর্মে অহিংসার উপদেশ রয়েছে। অর্জুনের মনে হয়, যুদ্ধ করা মানে এই আদর্শ থেকে সরে যাওয়া।
- মনস্তাত্ত্বিক সংকট: অর্জুনের মনে এক দ্বন্দ্ব – যুদ্ধ করা কি ধর্ম? নাকি যুদ্ধ এড়িয়ে চলা উচিত?
শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ: অর্জুনের অন্ধকার দূর করতে দৃষ্টির আলো
এই শ্লোকে অর্জুনের যে নৈতিক সংকট তা দূর করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাকে বিভিন্ন উপদেশ দেন। মূলত শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে জীবনের বড় উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য কখনো কখনো আত্মত্যাগ প্রয়োজন হয়। ধর্ম এবং কর্তব্যের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ বা সংকট একপাশে রেখে ধর্মের জন্যে যুদ্ধ করা আবশ্যক।
শ্রীকৃষ্ণ বুঝিয়ে দেন:
- ধর্মের পথে যে রণক্ষেত্রে অস্ত্র ধরতে হয়, সেখানে ভয় বা দ্বিধা রাখার জায়গা নেই।
- যে ব্যক্তি ধর্মরক্ষায় নিজের কষ্ট বা পরিণামকে পিছনে ফেলে কর্তব্যে অবিচল থাকে, সেই প্রকৃত ধর্মযোদ্ধা।
একটি গল্প: ভীষ্মের নৈতিক সংকট এবং তার সমাধান
এই শ্লোকের সাথে মিলিয়ে আমরা মহাভারতের ভীষ্মের একটি কাহিনী স্মরণ করতে পারি। ভীষ্ম, কৌরবদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যদিও তিনি জানতেন যে কৌরবরা অন্যায়ের পথে রয়েছে। তিনি মহাভারতের অন্যতম প্রধান নীতিবান চরিত্র।
ভীষ্ম কখনো অন্যায়কে সমর্থন করেননি, কিন্তু তিনি নিজ কর্তব্যে অবিচল ছিলেন। কৌরবদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা।
এখানে ভীষ্মের এই সিদ্ধান্তে কয়েকটি কারণ ছিল:
- কর্তব্য এবং প্রতিজ্ঞা: ভীষ্ম তাঁর পিতার জন্য আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন এবং কৌরব রাজবংশের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
- আদর্শ: ভীষ্ম জানতেন যে ধর্মের পথে থেকে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করা সম্ভব। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ধর্মরক্ষার প্রতীক হয়ে।
ধর্ম এবং কর্তব্যের সংঘাত: আমরা কী শিখতে পারি?
এই শ্লোক এবং গল্পটি আমাদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হই। ধর্ম এবং কর্তব্যের মাঝে যেকোনো সংঘাত থাকলে:
- অহিংসা: সব সময়ে অহিংসা ভালো, তবে যদি আত্মরক্ষা বা ধর্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ প্রয়োজন হয় তবে তা ধর্মই নির্দেশ করে।
- কর্তব্যে অবিচল: নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার ঊর্ধ্বে উঠে কর্তব্য পালনই প্রকৃত ধর্ম।
অর্জুনের মানসিক দ্বন্দ্বের সাথে আমাদের জীবনের সম্পর্ক
আমাদের আধুনিক জীবনে, আমরা প্রতিনিয়ত নানা সংকটে ভুগি এবং নিজের আদর্শ বা কর্তব্যের প্রতি প্রশ্ন তুলি। আমাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা কর্মজীবনে এমন পরিস্থিতি আসে যখন আমাদের দায়িত্ব পালনে সংকট বা দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তখন শ্রীকৃষ্ণের কথাগুলো আমাদের শান্তি দেয়, সহায়তা করে:
- মানসিক শান্তি: যখন আমরা সঠিক পথে থাকার জন্য মানসিক শক্তি অর্জন করি, তখনই আমরা প্রকৃত শান্তি পাই।
- ধর্মের পথে অবিচল: সঠিক কাজটি করার জন্য যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন, সেটাই প্রকৃত ধর্ম।
শ্লোকের প্রাসঙ্গিকতা আজকের যুগে
আজকের যুগে, যখন মানুষ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা, এবং সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে, এই শ্লোক আমাদের গভীর শিক্ষা দেয়। অর্জুন যেমন যুদ্ধের আগে তার নৈতিক সংকটে ভুগেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে আমরা নিত্যদিনের জীবনে ছোটবড় সংকটে পড়ি। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে:
- সত্যের পথে অবিচল থাকা: সত্যের পথে থাকতে সবসময় সহজ না হলেও তা মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য।
- ধর্মের পথে অহিংসা এবং সহমর্মিতা: সবসময় সহমর্মী এবং ক্ষমাশীল থাকা উচিত, তবে যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয় তবে ভয় বা দ্বিধা করা উচিত নয়।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোকটি আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রকাশ করে – ধর্মের পথে অবিচল থেকে নিজের কর্তব্য পালনে অবিচল থাকা।
এই শ্লোকটি শুধু প্রাচীন ভারতের এক ধর্মীয় কাহিনী নয়; এটি একটি জীবন দর্শন। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে এই আলাপ আমাদের শেখায় কীভাবে আমরা আমাদের নিজেদের জীবনের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি এবং নিজের কর্তব্য পালনে অটল থাকতে পারি।