১ম অধ্যায় অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক ৪৬

 শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ: মায়া কাটিয়ে উত্তরণের পথ (২.৪৬)

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রথম অধ্যায়ের ৪৬ নম্বর শ্লোকটি অর্জুনের গভীর মানসিক সংকটকে বর্ণনা করে। শ্লোকটি পড়লেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অর্জুনের মন কীভাবে শোক এবং সংকটে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এই শ্লোকটি শুধুমাত্র অর্জুনের নয়, মানব জীবনের প্রতি মুহূর্তের দ্বিধাগ্রস্ততার এক প্রতিফলন।

চলুন, এই শ্লোকটি নিয়ে আলোচনা করি, এবং একটি গল্পের মাধ্যমে এর গভীর অর্থ ও প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করার চেষ্টা করি।

 শ্লোকের অর্থ ও বিশ্লেষণ

শ্লোক:  

“এবমুক্ত্বার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ ।  

বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ ॥”

বাংলায় অর্থ:  

এমনি বলে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে রথের আসনে বসে পড়ল, তার ধনু এবং তীর ছেড়ে দিয়ে, শোকে বিহ্বল মনের সাথে।

এই শ্লোকে অর্জুন কেবলমাত্র বাহ্যিক অস্ত্র ছেড়ে দেয়নি, বরং তাঁর অন্তরাত্মাও শোক এবং দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তার সমস্ত দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে বসেছেন। এই অবস্থাটি কেবল একজন যোদ্ধার নয়, বরং জীবনের নানা পরিস্থিতিতে একজন মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন।

 কেন অর্জুনের মন এইভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ল?

১. প্রিয়জনের প্রতি মমতা: অর্জুনের কাছে কুরুক্ষেত্রের যোদ্ধারা শুধুই শত্রু নয়। তার পিতামাতা, গুরুজন, ভাই এবং আত্মীয়স্বজনও এই যুদ্ধের অংশ। এই কারণেই তার মনের আবেগ আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

২. অহিংসার চেতনা: যদিও অর্জুন এক যোদ্ধা, তবুও তার অন্তরে করুণা এবং অহিংসার অনুভূতি বিদ্যমান। তার কাছে এই যুদ্ধ মানে হলো প্রিয়জনদের হত্যা করা, যা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

 একটি পৌরাণিক গল্প: রামচন্দ্র ও রাবণের যুদ্ধ

অর্জুনের এই দ্বিধা আমাদের আরেকটি পৌরাণিক গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় – শ্রী রামচন্দ্র ও রাবণের যুদ্ধ। রামচন্দ্র যখন লঙ্কার যুদ্ধ করতে যান, তাঁর ভাই বিভীষণ তাঁকে রাবণকে হত্যা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু রামের মনেও এক মুহূর্ত দ্বিধা আসে। কেননা, রাবণ তপস্বী, অত্যন্ত শক্তিশালী এবং একজন প্রতিভাবান রাজার প্রতীক।

তবে, রামচন্দ্র জানতেন যে তাঁর ধর্ম এবং আদর্শের পথে চলাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই জন্য তিনি সেই সংকট কাটিয়ে উঠেছিলেন এবং ধর্মের পথে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

অর্জুনের এই দ্বিধাও ঠিক তেমনই। কিন্তু এখানেই কৃষ্ণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

 শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ: মায়া কাটিয়ে উত্তরণের পথ

কৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে শোক এবং মোহের এই আবরণ কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে যোদ্ধা তার কর্তব্য পালন করতে অক্ষম হয়। অর্জুন যদি তার শোক কাটিয়ে কর্তব্যের পথে ফিরে আসতে পারেন, তবে তিনি জীবনের প্রকৃত অর্থ এবং মোক্ষের পথে অগ্রসর হবেন।

এই শিক্ষাটি আমাদের জীবনের প্রতিটি দ্বিধার মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক। যতই কঠিন পরিস্থিতি আসুক, আমাদের উচিত আমাদের কর্তব্যের পথে অবিচল থাকা। 

 গুরুত্বপূর্ণ পাঠ: দ্বিধা কাটিয়ে কর্তব্য পালনের গুরুত্ব

এই শ্লোকটি অর্জুনের শোক প্রকাশ করলেও এর আড়ালে আছে গুরুতর শিক্ষা। আসুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে তুলে ধরা যাক:

  •  আবেগের চেয়ে কর্তব্য গুরুত্বপূর্ণ: জীবনে আবেগ মাঝে মাঝে আমাদের দিক পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। কিন্তু ঠিক তেমনই, কর্তব্যের পথে অবিচল থাকা এক মহান গুণ।
  •  মায়ার পর্দা: অর্জুনের শোক আসলে মায়ার প্রতীক। এই মায়া মানুষকে আসল সত্য থেকে বিচ্যুত করে। তাই মায়ার আবরণকে সরিয়ে রেখে সত্যের পথে চলতে শেখা আমাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
  •  শোক এবং সংকটের মুহূর্তে শিক্ষাগ্রহণ: জীবনের প্রতিটি সংকট আমাদের শিক্ষা দেয়। অর্জুনের এই সংকটও তাকে কৃষ্ণের কাছ থেকে জীবনের মহান শিক্ষাগুলি শিখতে সাহায্য করেছিল।

 গল্পের পর্যালোচনা: অর্জুনের মানসিক সংকট এবং আমাদের জীবনের দিকনির্দেশনা

অর্জুনের এই দ্বিধাগ্রস্ত মনের অবস্থা আমাদের জীবনের নানান জটিল পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কখনও কখনও আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গ ছেড়ে যেতে চাই না, কখনও জীবনের কঠিন পরিস্থিতি আমাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। অর্জুনের শোক সংবিগ্ন মানস এই সত্যটিই প্রতিফলিত করে।

আমাদের শিক্ষণীয় দিক:  

  •  আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি: অর্জুনের মতো আমাদেরও উচিত আবেগকে সামলানো, যাতে আমাদের মনোভাব এবং পদক্ষেপ সঠিক দিকে পরিচালিত হয়।
  •  দ্বিধাগ্রস্ততা কাটানোর উপায়: ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসরণ করে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া – এটি অর্জুনের শিক্ষার সবচেয়ে বড় দিক।

 অর্জুনের শোকের একটি চূড়ান্ত অর্থ

এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ শিখিয়ে দেন যে আমাদের উচিত জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে আহ্বান করা। শোক, দ্বিধা বা মোহ আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারে, তবে যদি আমরা সেইসব আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তবে আমরা সঠিক পথে চলতে সক্ষম হব।

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রতিটি শ্লোকই জীবনের এক গভীর পাঠ, আর এই শ্লোকটি বিশেষ করে সেই পাঠকে বোঝায় যা জীবনকে স্থিতিশীল করে। 

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার এই শ্লোক থেকে আমরা শিখতে পারি কিভাবে জীবনের কঠিন মুহূর্তে শোক ও দ্বিধাকে কাটিয়ে কর্তব্যে অবিচল থাকা উচিত। অর্জুনের এই মনোভাব আমাদেরও জীবনের প্রতি মোহ এবং শোক কাটিয়ে নিজ কর্তব্যে অবিচল থাকতে শেখায়। 

আসুন, আমরা সবাই এই শিক্ষাটি অন্তরে ধারণ করি এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এটি আমাদের দিকনির্দেশক হোক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top