শ্লোক:
“ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান্ ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ ॥৫॥”
এই শ্লোকটি মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। এখানে অর্জুনকে সাহায্য করতে যে সকল শক্তিশালী রাজা ও বীরেরা প্রস্তুত হচ্ছেন, তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, কাশিরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ এবং শৈব্য—এঁরা সকলেই বীরপুরুষ, যারা পাণ্ডবদের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও কুরুক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুতে কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনের মাধ্যমে ধর্ম, করুণ, জীবনের মূল প্রশ্ন ও মানসিক দোটানা নিয়ে আলোচনা করে। মহাভারতএর এই মহান যুদ্ধে কেবল দুই পক্ষের সংঘর্ষ নয়, ছিল ধর্ম ও অধর্মের লড়াই। শ্রীকৃষ্ণ এই যুদ্ধে ছিলেন পাণ্ডবদের সাথে, যেখানে অর্জুনের মানসিক দ্বিধা কাটিয়ে ধর্মের পথে যুদ্ধ করার প্রেরণা দিয়েছিলেন।
শ্লোকের প্রতিটি চরিত্রের পরিচয়
এই শ্লোকে বর্ণিত প্রতিটি বীর এক একটি বিশেষ গুণের প্রতীক। তাঁরা ছিলেন কেবল সামরিক শক্তির অধিকারী নন, তাঁদের প্রত্যেকের জীবনে একটি বিশেষ ধর্মীয় মূল্যবোধও জড়িত। আসুন তাঁদের সম্পর্কে কিছুটা জানি।
ধৃষ্টকেতু
ধৃষ্টকেতু ছিলেন চেদি রাজ্যের রাজা।
মহাভারতে তাঁর বীরত্ব ও সাহসের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি পাণ্ডবদের পক্ষ নেন এবং তাঁদের জন্য নিজের জীবন দানের অঙ্গীকার করেন।
চেকিতান
চেকিতান ছিলেন যাদব বংশের বীর, কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
শ্রীকৃষ্ণের মতো চেকিতানও ধর্মপথে পাণ্ডবদের পাশে দাঁড়ান।
এই যুদ্ধে তিনি অর্জুনের বিশেষ সহায়ক ছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ কৌশলে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন।
কাশিরাজ
কাশিরাজ বা বারাণসীর রাজা ছিলেন তেজস্বী ও সাহসী।
বারাণসী, যা ভারতীয় সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, সেই ভূমির রক্ষক হিসেবে কাশিরাজ পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
তিনি কেবল একজন বীর যোদ্ধা নন, ধর্মপ্রাণ রাজাও ছিলেন।
পুরুজিৎ ও কুন্তিভোজ
পুরুজিৎ ও কুন্তিভোজ ছিলেন কুন্তীর আত্মীয় এবং মথুরা রাজ্যের অধিপতি।
তাঁরা অর্জুনের প্রতি স্নেহ ও ভালবাসা থেকে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন।
তাঁদের কৌশল ও বীরত্ব যুদ্ধের সময় পাণ্ডবদের অসীম সাহস ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল।
শৈব্য
শৈব্য ছিলেন রাজপুত্র এবং নরপুঙ্গব।
তাঁর চরিত্রের মধ্যে রাজপুত্রের মর্যাদা, শক্তি ও সাহসের প্রতীক বিদ্যমান।
শৈব্য পাণ্ডবদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষা: যুদ্ধের মাধ্যমেও ধর্মপালন সম্ভব
এই শ্লোকের মাধ্যমে কৃষ্ণ আমাদের শেখান যে, যারা সত্য ও ধর্মের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত, তাঁদের সহায়ক হিসেবে অনেক মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে থাকেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ একদিকে একটি মহাজাগতিক যুদ্ধ হলেও, অন্যদিকে প্রতিটি মানুষের অন্তরের যুদ্ধকেও প্রতিনিধিত্ব করে। ধর্মের পথে অগ্রসর হতে হলে কখনও কখনও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অর্জুনের মতো আমাদেরও নানা বাধার মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু সেই পথ ধরেই চূড়ান্ত মুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে হয়।
ধর্ম ও যোদ্ধাদের মানসিকতা
এই মহাযুদ্ধে যোগদানকারী যোদ্ধারা কেবল অস্ত্র ধারণ করেননি, তাঁদের অন্তরে ধর্মের প্রতীকও বহন করতেন। এঁরা জানতেন যে জীবন ত্যাগ করেও পরের জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর রাখা তাঁদের কর্তব্য। তাই তাঁরা জীবনমৃত্যুর ভয়কে অতিক্রম করে যুদ্ধে প্রবেশ করেছিলেন।
কেন ধর্মপথে এই যুদ্ধ জরুরি?
- ধর্মের রক্ষা: পাণ্ডবদের পক্ষে দাঁড়ানো মানে ধর্ম ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
- অধর্মের নাশ: কৌরবদের মধ্যে যারা আত্মম্ভরিতা, অবিচার ও অধর্মের পথ অনুসরণ করেছিল, তাদের সমাপ্তি অনিবার্য ছিল।
- পুণ্যের প্রতিষ্ঠা: একমাত্র ধর্মের পথে চলেই পুণ্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই যুদ্ধে তাই ধর্ম ও পুণ্যের বিজয় অনিবার্য।
মহাভারতের গল্পের মূল্যায়ন: আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলে?
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই নানা ধরনের লড়াই থাকে। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র—সব ক্ষেত্রেই আমাদের কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জ আসে। মহাভারতের এই যোদ্ধাদের মতোই আমাদেরও আত্মবিশ্বাস ও নির্ভীকতার সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।
এই শ্লোক থেকে আমাদের শিক্ষা
সাহস ও বীরত্ব: ধৃষ্টকেতু, চেকিতান এবং কাশিরাজের মতো আমাদেরও বীরত্বের পরিচয় দিতে হবে।
বিশ্বাস ও ধর্মবোধ: পাণ্ডবদের মতোই ধর্মের প্রতি অবিচল বিশ্বাস রাখা জরুরি।
আত্মত্যাগের মানসিকতা: নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য কিছু করার মানসিকতা থাকা উচিত।
এই শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ধর্মের পথে যত কঠিন বাধাই আসুক না কেন, আমাদের সাহস এবং বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলা উচিত। এই মহাযুদ্ধের সাহসী যোদ্ধারা যেমন পরম ত্যাগের প্রতীক, তেমনি তাঁরা আমাদের জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে পথ প্রদর্শক।