১ম অধ্যায়: অর্জুনবিষাদযোগ শ্লোক: ৬

 মহাভারতের অমৃতভাণ্ডার

হিন্দু ধর্মের মহাকাব্য মহাভারত শুধু একটি গল্প নয়, এটি আমাদের জন্য এক অপরিসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার। আজ আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক নিয়ে, যেখানে মহারথী এবং বীর যোদ্ধাদের নাম তুলে ধরা হয়েছে। 

শ্লোক: ৬

“যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্ ।

সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ ॥৬॥”

এই শ্লোকে বলা হচ্ছে যে যুধামন্যু, উত্তমৌজা, সৌভদ্র (অভিমন্যু) এবং দ্রৌপদেয়গণ (দ্রৌপদীর পুত্ররা) সকলেই মহারথী।

মহারথী কে?

প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক, মহারথী কারা। মহারথী হল সেই যোদ্ধা, যিনি একা হাজার হাজার যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম। এরা শুধু যুদ্ধশক্তিতে নয়, বরং আধ্যাত্মিক শক্তি, ধৈর্য ও বীর্যগুণে সমৃদ্ধ। মহাভারতে বিভিন্ন মহারথীকে বিভিন্ন সময় যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা গেছে।

 যুধামন্যু: অসীম বীরত্বের প্রতীক

যুধামন্যু ছিলেন এক অপরিসীম বীরত্বের অধিকারী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর যুদ্ধকৌশল, সাহস এবং ন্যায়ের জন্য অবিচল নিষ্ঠা তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বীরত্ব ও সাহস:  

 যুধামন্যু ছিলেন নিঃস্বার্থ এবং সম্পূর্ণরূপে ভক্তিশীল।

 তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে তিনি তাঁর যোদ্ধাদের সর্বদা রক্ষা করবেন।

উত্তমৌজা: ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি

উত্তমৌজা ছিলেন যুধামন্যুর মতোই পাণ্ডবদের বিশ্বস্ত সহচর। উত্তমৌজার ধৈর্য এবং দৃঢ়তার জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। যুদ্ধে তিনি অসংখ্যবার প্রাণ দানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

ধৈর্য ও বিশ্বাস:  

 উত্তমৌজা ছিলেন পরম ভক্ত এবং ন্যায়পরায়ণ যোদ্ধা।

 কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল অমূল্য।

 সৌভদ্র (অভিমন্যু): এক উদীয়মান মহারথীর কাহিনী

অভিমন্যু, অর্জুনের পুত্র ও শ্রীকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্র, ছিলেন এক অনন্য যোদ্ধা। তিনি ষোল বছর বয়সেই মহারথী উপাধি পান। তাঁর সাহস, যুদ্ধকৌশল এবং আত্মত্যাগের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন।

চক্রব্যুহ ও অভিমন্যুর আত্মত্যাগ:  

 অভিমন্যু একা চক্রব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও তাঁর জন্য সেটি ছিল প্রাণসংহারী।

 অভিমন্যুর মৃত্যু আমাদের দেখায় যে যোদ্ধারা শুধু যুদ্ধ করেন না, তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনের জন্য, সত্যের জন্য আত্মত্যাগও করতে পারেন।

 দ্রৌপদেয়গণ: মহারথীর উত্তরসূরিরা

দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ছিলেন যথাক্রমে প্রতিবিন্দ্য, সুতসোম, শ্বত, স্রুতকর্মা এবং স্রুতসেন। এরা প্রত্যেকেই তাঁদের পিতাদের মতোই মহারথী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রতিটি ধাপে দ্রৌপদেয়গণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

দ্রৌপদেয়দের গুণাবলী:  

 এরা প্রত্যেকেই পাণ্ডবদের উত্তরাধিকার এবং সত্যের জন্য লড়াই করেছেন।

 তাঁদের নির্ভীক মনোভাব এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল অনবদ্য।

 মহারথীদের বিশেষত্ব

কেন তাঁরা মহারথী?  

 যুদ্ধশক্তি: মহারথীরা একা হাজারের বেশি যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারদর্শী।

 আধ্যাত্মিক শক্তি: এঁরা শুধু বাহুবলে নয়, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক শক্তিতেও মহৎ।

 ন্যায় ও ধর্মে অবিচল: ন্যায় ও ধর্মের পথ থেকে তাঁরা কখনও বিচ্যুত হননি।

 মহাভারতের এই মহারথীদের থেকে আমরা কি শিখতে পারি?

 সাহস ও আত্মত্যাগ: নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য জীবন উৎসর্গ করাই হলো মহারথীদের মূল আদর্শ।

 ধৈর্য ও সংকল্পবদ্ধতা: যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন ধৈর্য প্রয়োজন, তেমনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রয়োজন।

 অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো: মহারথীরা কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি।

 শ্লোকের অন্তর্নিহিত শিক্ষা

এই শ্লোকটি আমাদের জানায়, জীবনের পথে যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করা যায় সাহস, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। মহাভারতের মহারথীদের মতো আমরাও জীবনে সাহসিকতা, সততা এবং ন্যায়বোধের পথে চললে, সকল প্রতিকূলতা জয় করতে পারব।

হিন্দু ধর্মের এই মহাকাব্যিক কাহিনী আমাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে এবং আমাদের মূল্যবোধগুলোকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top