মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে গীতার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আমাদের ধর্ম ও নীতির শিক্ষা দেয়। এই মহাযুদ্ধ শুধু ক্ষমতার লড়াই ছিল না, বরং ন্যায়অন্যায়, ধর্মঅধর্মের মধ্যে লড়াই। প্রথম অধ্যায়ের এই শ্লোকটিতে যুদ্ধক্ষেত্রে জড়ো হওয়া বিশিষ্ট যোদ্ধাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, যারা ইতিহাসে নিজেদের বীরত্বের জন্য খ্যাত।
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ ॥৮॥
বাংলা অর্থ:
এই শ্লোকে দ্যূতরূপে কুরু পক্ষের প্রধান প্রধান বীর যোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে। এখানে ‘ভবান’, ‘ভীষ্ম’, ‘কর্ণ’, ‘কৃপ’, ‘সমিতিঞ্জয়’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘বিকর্ণ’, এবং ‘সৌমদত্তি’—এই সব বিখ্যাত যোদ্ধাদের কথা বলা হয়েছে।
এই শ্লোকটি স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন এমন যোদ্ধারা কেবলমাত্র শারীরিক শক্তির নয়, নৈতিক শক্তিরও প্রতীক। তবে, এই যোদ্ধাদের মধ্যে কে ছিলেন এবং তারা কেন এত বিশেষ ছিল, সেটাই বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
ভীষ্ম: প্রতিজ্ঞা ও ত্যাগের প্রতীক
ভীষ্ম ছিলেন কুরুবংশের মূল স্তম্ভ। তাঁর জীবনটা এক নৈতিক আদর্শ এবং প্রতিজ্ঞার প্রতীক। তরুণ বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় আজীবন ব্রহ্মচারী থাকার শপথ নিয়েছিলেন, কেবলমাত্র তাঁর পিতার ইচ্ছাপূরণের জন্য। মহাভারতে তাঁকে নিঃস্বার্থতার উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। ভীষ্ম তাঁর অসাধারণ যুদ্ধকৌশল ও নীতিগত আদর্শের জন্যও সম্মানিত ছিলেন।
ভীষ্মের জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয়:
ত্যাগ ও প্রতিজ্ঞা: জীবনের লক্ষ্য এবং আদর্শের প্রতি একাগ্রতা রাখা।
ধর্মের নৈতিকতা: সঠিককে সঠিক এবং ভুলকে ভুল বলা।
কর্ণ: বন্ধুত্ব ও সম্মান রক্ষার প্রতীক
কর্ণ মহাভারতের অন্যতম ট্র্যাজিক চরিত্র। সুতপুত্র হিসেবে তিনি জন্মের পর থেকেই বৈষম্যের শিকার হন, কিন্তু দানশীলতা, সাহস ও আত্মসম্মানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কর্ণের চরিত্র আমাদের শেখায়, কেবলমাত্র রাজবংশে জন্ম নয়, নিজগুণেই মানুষ উচ্চ হতে পারে।
কর্ণের জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয়:
সম্মানের প্রতি নিষ্ঠা: কর্ণ সবসময় তাঁর বন্ধু দুর্যোধনের সম্মান রেখেছিলেন।
দানশীলতা: তিনি কখনোই কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি, এই জন্য তাঁকে ‘দানবীর’ বলা হয়।
কৃপাচার্য: জ্ঞানের ভান্ডার
কৃপাচার্য কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি একাধারে যুদ্ধ বিদ্যা এবং ধর্ম শাস্ত্রের বিদ্বান ছিলেন। কৃপাচার্যের জীবন আমাদের শেখায় যে, শারীরিক শক্তির পাশাপাশি জ্ঞানও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কৃপাচার্যের জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয়:
জ্ঞান ও আচার: জীবনের নানা পরিস্থিতিতে জ্ঞান ও বিবেকের প্রয়োগ।
দায়িত্ববোধ: কুরুবংশের প্রধান গুরু হিসেবে কৃপাচার্য তাঁর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
অশ্বত্থামা: বীরত্ব ও নিষ্ঠুরতার দ্বন্দ্ব
দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা জন্ম থেকেই এক বীর যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর অসাধারণ শৌর্য্য ও বীরত্ব তাঁকে কুরুক্ষেত্রের অন্যতম শক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত করে। তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের প্রতি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তিনি নীতির বিরুদ্ধে যান, যা থেকে আমাদের একটি বড় শিক্ষা পাওয়া যায়।
অশ্বত্থামার জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয়:
বীরত্বের সঠিক প্রয়োগ: ক্ষমতা থাকলেই তাকে সদ্ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিশোধের তাড়না থেকে বিরত থাকা: অশ্বত্থামার জীবন আমাদের শেখায় যে প্রতিশোধের তাড়নায় নীতি বিসর্জন দিলে তা আমাদের পরিণতির ওপর প্রভাব ফেলে।
বিকর্ণ: অন্যায়ের বিরোধিতা করার সাহস
বিকর্ণ কৌরবদের মধ্যে অন্যতম একজন নীতিবান যোদ্ধা ছিলেন। যদিও তিনি দুর্যোধনের দলে ছিলেন, তথাপি দ্রৌপদীকে বস্ত্রহরণের ঘটনায় একমাত্র বিকর্ণই ছিলেন যিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। বিকর্ণের চরিত্র আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেয়, এমনকি নিজের দলের বিরুদ্ধে হলেও।
সৌমদত্তি: সংগ্রামের মানসিকতা
সৌমদত্তি ছিলেন ভীষ্মের মতোই অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ যোদ্ধা। তিনি নিজের সাহস ও শক্তির জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে কৌরবদের পক্ষে লড়েছিলেন।
সৌমদত্তির জীবন থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয়:
সাহসিকতা ও সংকল্প: বিপদের সময়েও দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে দাঁড়ানো।
যুদ্ধের মাঠে নৈতিক আদর্শ রক্ষা: সৌমদত্তির সাহসিকতা আমাদের সাহসিকতার মূল্য শিক্ষা দেয়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ধর্মীয় তাৎপর্য
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুধু কুরুপাণ্ডবদের ক্ষমতার লড়াই ছিল না, এটি ছিল ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং নীতির স্বীকৃতির জন্য একটি যুদ্ধ।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধের কিছু শিক্ষা:
সত্যের জন্য সংগ্রাম করা: মহাভারত আমাদের সত্যের জন্য সংগ্রাম করতে শেখায়।
নিজ দায়িত্বে অবিচল থাকা: প্রতিটি যোদ্ধা নিজের দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন।
নীতির অনুসরণ: শুধুমাত্র শারীরিক শক্তি নয়, নীতিগত আদর্শেরও প্রয়োজন।
মহাভারতের এই চরিত্রগুলি থেকে কীভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারি?
কুরুক্ষেত্রের এই মহাযোদ্ধাদের জীবন ও আদর্শ আমাদের নৈতিকতা, আদর্শ এবং ধর্মের পথ প্রদর্শন করে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা:
আত্মসম্মান ও দায়িত্ব পালন: ভীষ্ম ও কর্ণের মতো নিজের দায়িত্বের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে।
নীতিগত সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা: ভীষ্মের মতো আদর্শগত নীতিতে স্থির থাকা প্রয়োজন।
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা: আমাদেরকে ক্ষমাশীল হওয়া এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্য ধরে চলা উচিত।
মহাভারত এবং গীতা কেবল এক মহাকাব্য নয়, এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নীতির প্রয়োগ ও পথ প্রদর্শন করে।