সঞ্জয় ঊবাচ
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্ ।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ ॥১॥
আমি, তুমি আর আমাদের জীবনসংগ্রাম
আমাদের জীবন চলার পথে কত না সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও চাকরি হারিয়ে, কখনও সম্পর্কের টানাপোড়েন, আবার কখনও ভয়ঙ্কর ব্যর্থতায় মন ভেঙে যায়। মনে হয় যেন সবকিছু শেষ, সামনে আর কোনও আলো নেই। এই সময়ে আমাদের মনে উঠে আসে একটাই প্রশ্ন: “আমি কীভাবে এই অন্ধকার থেকে বের হবো?”
ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে অর্জুনও ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তিনি ভয়, সংকোচ আর অসহায়তায় অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন সেই শক্তিশালী কথা, যা আমাদের আজও জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে শেখায়। গীতা আমাদের শেখায়— সমস্যার সামনে দাঁড়াও, নিজেকে চিনো, এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজে নাও।
১. বাস্তব জীবনের সমস্যা এবং গীতার সমাধান
আমাদের জীবনে প্রতিটি সমস্যা আসলে একটি পরীক্ষা। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক:
চাকরি হারানো:
আজকের যুগে চাকরি হারানো একটা সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক চাপ আর আত্মবিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণায় আমরা মনে করি, “সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।” কিন্তু গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“ন হি কল্যাণকৃত্ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।”
তুমি যদি ভালো কাজ করো, যদি নিজের প্রচেষ্টায় অবিচল থাকো, তবে কোনও পরিস্থিতিতেই তোমার ক্ষতি হবে না।
একটি নতুন সুযোগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো। চাকরি হারানো মানে তোমার সামনের দরজা বন্ধ হওয়া, কিন্তু পিছনের দরজা দিয়ে নতুন কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। হতাশ না হয়ে এই সময়ে নিজেকে দক্ষ করো, নতুন কিছু শিখে আবার জীবনের পথে এগিয়ে যাও।
সম্পর্কের ভাঙন:
প্রেম হোক বা বন্ধুত্ব, সম্পর্কের ভাঙন আমাদের সবচেয়ে বড় কষ্ট দেয়। এই অবস্থায় আমরা নিজেদের দোষারোপ করি, নিজেদের একা ভাবি। কিন্তু গীতার শিক্ষা বলে:
“অস্মিন্ মনুষ্যলোকে দ্বিধা দুই ভাগে বিভক্ত: এক পথ আত্মোন্নতির, আরেক পথ আত্মধ্বংসের।”
সম্পর্ক ভাঙলে তা নিজেকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ করে দেয়। নিজের অনুভূতিগুলোকে বুঝে গ্রহণ করো এবং জীবনের নতুন লক্ষ্য স্থির করো। মানুষ আসবে আর যাবে, কিন্তু নিজের ভেতরের শান্তি ধরে রাখা তোমার দায়িত্ব।
পরীক্ষা বা জীবনে ব্যর্থতা:
অনেক সময় আমরা কোনো পরীক্ষায় বা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যর্থ হই। এই ব্যর্থতা আমাদের মনের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। তখন মনে হয়— “আমার দ্বারা আর কিছুই হবে না।” কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন:
“কর্মণ্যে বধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
তোমার দায়িত্ব শুধু চেষ্টা করা, ফল কী হবে তা নিয়ে ভাবা তোমার কাজ নয়। তুমি তোমার সেরাটা দাও। সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই হোক, সেটাকে গ্রহণ করো। ব্যর্থতা মানে শেখার একটি নতুন সুযোগ।
২. সংকটের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন যে সংকটের মুহূর্তে আমাদের মন শান্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের চিন্তাগুলো যখন অশান্ত হয়, তখন আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিই। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি সুখে-দুঃখে সমান থাকে, সেই ব্যক্তি জীবনযুদ্ধে সত্যিকারের বিজয়ী।”
(গীতা ২.১৫)
অশান্ত মনের কারণে অনেক সময় আমরা ছোট্ট সমস্যাকেও বড় করে দেখি। নিজের মনকে শান্ত রাখতে শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্যান খুবই উপকারী হতে পারে। প্রতিদিন একটু সময় নিজেকে দিন, নিজের ভেতরের শক্তিকে অনুভব করুন।
৩. প্রেরণার জন্য গীতা: জীবনকে নতুনভাবে দেখা
গীতা আমাদের শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং বাস্তব জীবনের জন্য একটি “ম্যানুয়াল”। এটি আমাদের শেখায় কীভাবে জীবনের সমস্যা এবং হতাশা থেকে বেরিয়ে আসা যায়।
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“উদ্ধরেদ্ আত্মনাত্মানং, নাত্মানমবসাদয়েত।”
(গীতা ৬.৫)
নিজেকে তুমি নিজেরই সাহায্যে উন্নত করো, নিজেরই সাহায্যে নিজেকে ওঠাও। তোমার ভিতরেই সেই শক্তি আছে যা সব বাধাকে অতিক্রম করতে পারে।
নিজেকে প্রশ্ন করো— “আমি আজ কীভাবে এগোবো?”
জীবনের প্রতিটি সমস্যার উত্তর তোমার ভেতরেই আছে। গীতার শ্লোকগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়— প্রতিটি সংকটের মধ্যে একটি সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।
অর্জুনের মতো আমরাও কখনও কখনও ভয় পাই, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু সেই মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণের বাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কোনও বাধার চেয়ে ছোট নই। সমস্যা আসবেই, কিন্তু তুমি কীভাবে সেই সমস্যার মোকাবিলা করবে সেটাই তোমার জীবনকে বদলে দেবে।
তাহলে এবার নিজেকে প্রশ্ন করো: তুমি কি তোমার জীবনের এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভয় পাবে, নাকি গীতার শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে?
সমাপ্তি: নিজের জীবনের শক্তি নিজেই আবিষ্কার করো, কারণ গীতার শিক্ষা বলে— “তুমি নিজেই তোমার পথের প্রদীপ।”
এই লেখার মাধ্যমে গীতার অনুপ্রেরণাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করার একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা। গীতার শিক্ষাগুলো হৃদয়ে ধারণ করে আমরা আমাদের জীবনের সংকটগুলো সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারি।