২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ১০

২.১০ঃ বিশ্বাসের প্রতীক

জীবনে কখনো এমন সময় আসে যখন আমরা প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে যাই—কোন পথটি সঠিক? কোনটি ভুল? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম শ্লোকে, অর্জুনের এমনই এক সংকটের মুহূর্তে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক কিছু শেখায়। শ্লোকটি বলছে:

তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ।

এই শ্লোকে অর্জুন, যিনি যুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের মৃদু হাসি ও সান্ত্বনার কথা উঠে এসেছে। শ্রীকৃষ্ণের এই আচরণ আমাদের জীবনের সংকটে কীভাবে স্থির থাকা যায় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তা শেখায়।

সংকটের মুখে হাসি—অহংকার নয়, বিশ্বাসের প্রতীক

প্রথমে ভগবান কৃষ্ণের “প্রহসন্নিব” বা মৃদু হাসির দিকে নজর দিন। এই হাসি কোনো বিদ্রূপ নয়; বরং এটি সংকেত দেয় যে, সংকটের সময়ও আপনি মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। জীবনেও যখন আপনি বিশাল সমস্যার সম্মুখীন হন, মনে রাখবেন, অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে সেই সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে।

উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি চাকরি হারিয়েছেন। প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে হতাশা, কিন্তু আপনি যদি আত্মবিশ্বাস ধরে রাখেন এবং মনের মধ্যে বলেন, “এই সমস্যার মধ্যেই কোনো সুযোগ লুকিয়ে আছে,” তবে আপনি নতুন কিছু শিখতে এবং উন্নতির পথ খুঁজে পাবেন। শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষায় আপনার মনে রাখতে হবে:

“সমত্বং যোগ উচ্যতে”—(ভগবদ্গীতা, ২.৪৮)
যা-ই ঘটুক, মানসিক স্থিরতা বজায় রাখাই যোগ।

দ্বিধা থেকে মুক্তি: দায়িত্ব এবং কর্মের গুরুত্ব

অর্জুন তাঁর যুদ্ধ করার কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছিলেন, কারণ তিনি তাঁর প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এই অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”—(ভগবদ্গীতা, ২.৪৭)
তোমার কাজ করা কর্তব্য, ফলের চিন্তা নয়।

তোমার জীবনেও যখন কঠিন পরিস্থিতি আসে, নিজের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। কিন্তু মনে রেখো, আমাদের দায়িত্ব পালন করা সবচেয়ে বড় কর্ম। উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের একজন সদস্য যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন হয়তো কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবন সামলানো কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়েই প্রকৃত শান্তি আসে।

কর্মফল থেকে বিচ্ছিন্নতা—মানসিক শান্তির মূলমন্ত্র

সংকটের সময় আমরা অনেক সময় অকারণে ফলের চিন্তা করে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। এই দুশ্চিন্তা আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ভগবদ্গীতা শেখায়:

“যোগঃ কর্মসূ कौशलं।”—(ভগবদ্গীতা, ২.৫০)
কর্মে দক্ষতাই যোগ।

এই শিক্ষাটি কাজে লাগিয়ে আপনি যদি কেবল আপনার কাজের ওপর মনোযোগ দেন, তবে ফলাফল নিজের পথে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, পরীক্ষার সময় আপনি যদি শুধুমাত্র পড়াশোনায় মন দিন এবং ফলাফল নিয়ে বেশি চিন্তা না করেন, তবে আপনার মানসিক চাপ অনেকটাই কমবে।

দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলুন—মনের স্থিরতার চর্চা করুন

ভগবদ্গীতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলা। আমাদের মন প্রায়ই “আমি পারব না” বা “এই কাজটি আমার জন্য নয়” এরকম দ্বিধায় পড়ে যায়। কৃষ্ণ বলেন:

“দ্বন্দ্বাতীতঃ সুখসংজ্ঞী।”
দ্বন্দ্বমুক্ত হওয়া মানসিক শান্তির প্রথম ধাপ।

আপনার জীবনের উদাহরণ ভাবুন: আপনি একটি বড় ব্যবসায় ঝুঁকি নেওয়ার কথা ভাবছেন, কিন্তু দ্বিধায় পড়েছেন। এই সময় আপনার প্রয়োজন হলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি স্থির মানসিক অবস্থা।

সংকটে কীভাবে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ আপনার পথপ্রদর্শক হতে পারে

আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একবার আমি একটি বড় প্রকল্প হাতে নিই, যেখানে প্রথমে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ক্লায়েন্টদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু গীতার এই শ্লোকগুলি আমাকে মনে করিয়ে দিল, “কর্মটি করাই আমার কর্তব্য; ফলের জন্য ভীত হওয়া নয়।” সেই মানসিকতা নিয়ে আমি আবার চেষ্টা করি এবং সফল হই।

আপনার ক্ষেত্রেও যদি এমন সংকট আসে, গীতার শ্লোকগুলি আপনাকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে।

আপনি কীভাবে গীতার এই শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করবেন?

জীবনের প্রতিটি সংকটই আমাদের শেখায়। প্রশ্ন হলো, আপনি সেই সংকটের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত তো? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষা অনুসরণ করে, আপনি নিজের জীবনে স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস, এবং দায়িত্বশীলতার চর্চা করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top