শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ যে গভীর জীবনমুখী দর্শন দিয়েছেন, তা আজও আমাদের জীবনের নানা সংকটে পথ দেখায়। আজ আমি শেয়ার করব এমন এক শ্লোকের মর্মার্থ যা আপনাকে জীবনের বড়ো সমস্যাগুলিকে সহজভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। শ্লোকটি হল:
“অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ ॥”
শ্লোকটির অর্থ এমন: “তুমি এমন বিষয় নিয়ে শোক করছ যা শোক করার মতো নয়। কিন্তু পণ্ডিতরা, যারা প্রকৃত জ্ঞানী, তারা জীবিত বা মৃত কারও জন্য শোক করেন না।”
আপনার জীবনের প্রতিটি সমস্যার জন্য কি আপনি একইভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন? কীভাবে আমরা শ্রীকৃষ্ণের এই বার্তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনের জটিল পরিস্থিতিগুলিকে সহজ করতে পারি? চলুন বিস্তারিত আলোচনা করি।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ এবং সমস্যা
১. অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতা
আমাদের অনেক সময় চরম প্রত্যাশা নিয়ে কোনও কাজে নামি। ধরুন, আপনি চাকরির জন্য খুব পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিয়েছেন, কিন্তু ফলাফল আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী আসেনি। হতাশা আপনাকে গ্রাস করল। এই অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোক আপনাকে বলে, “ব্যর্থতার জন্য শোক করো না। এটি তোমার চেষ্টা ও অভিজ্ঞতার অংশ।”
গীতার আরেকটি শ্লোক এখানে গুরুত্বপূর্ণ:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(তোমার অধিকার শুধুমাত্র কর্মে, ফলের ওপর নয়।)
আপনি যদি এই কথাগুলি হৃদয়ে গ্রহণ করেন, তাহলে দেখবেন আপনি ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে নিজেকে নতুনভাবে প্রস্তুত করতে পারবেন।
২. সম্পর্কের টানাপোড়েন
পরিবারে বা বন্ধুত্বে ভুল বোঝাবুঝি এবং দ্বন্দ্ব খুবই সাধারণ। আমরা প্রিয়জনের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে শোকাহত হয়ে পড়ি। এই পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে রাখতে হবে—”জীবিত বা মৃত, আত্মার কোনো মৃত্যু নেই। সম্পর্কগুলি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা চিরন্তন।”
এখানে গীতার আরেকটি উপদেশ গুরুত্বপূর্ণ:
“বিনাশে অযোগ্যম্ আত্মানং, নিত্যশুদ্ধম্ অচলং ধ্রুবম্।”
(আত্মা বিনাশী নয়। এটি চিরন্তন, পবিত্র এবং অপরিবর্তনীয়।)
আপনি যদি বুঝতে পারেন যে সম্পর্কগুলিও জীবনের পথের অংশ, তাহলে আপনি সহজেই এগুলিকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন।
৩. অপ্রাপ্তি বা অভাববোধ
অনেক সময় আমাদের মনে হয়, আমরা যা চাই তা পাচ্ছি না। অর্থ, যশ, খ্যাতি—কিছুই যেন যথেষ্ট নয়। আপনি কি কখনও অনুভব করেছেন যে চাওয়া পূরণের পরও আপনার মন ভরে না? শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলেন, “অভাববোধ হলো মায়ার সৃষ্টি। নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজতে হবে।”
গীতার আরেকটি শ্লোক এখানে প্রাসঙ্গিক:
“যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তত্ত্ প্রাপ্য শুভাশুভং।”
(যে ব্যক্তি আনন্দ এবং দুঃখ উভয়কেই সমভাবে গ্রহণ করতে পারে, সে-ই শান্তি খুঁজে পায়।)
আপনি যদি আপনার অর্জনের মধ্যে সুখ খুঁজতে ব্যর্থ হন, তবে আপনার অভ্যন্তরীণ প্রশান্তির জন্য কাজ করতে হবে।
গীতার মন্ত্র এবং জীবনের পাঠ
১. মনকে সংযত করা
আমাদের জীবনে শোকের সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো আমাদের মনের অসংযম। মনের অবস্থা যেমন হবে, আমাদের জীবনও তেমনই চলবে। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“উদ্ধরেত আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্।”
(তোমার আত্মাকে নিজে উন্নত করো, নিজেকে নিচে নামিয়ো না।)
আপনি যখন নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনবেন এবং নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনবেন, তখন আপনি দেখবেন জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলি আর আপনাকে ততটা বিচলিত করে না।
২. অপরিবর্তনশীল সত্য গ্রহণ করা
আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তন অনিবার্য। শ্রীকৃষ্ণের শ্লোকের মূল কথা হল, জীবনের সাময়িক বিষয়গুলির জন্য শোক করা অনর্থক। তিনি বলেন:
“অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।”
(চর্চা এবং বৈরাগ্যের মাধ্যমে মনকে স্থিতিশীল করা যায়।)
আপনার জীবনে যা কিছু ঘটুক না কেন, তার প্রকৃতিকে বুঝে তাকে মেনে নেওয়া শিখতে হবে।
উপসংহার
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণের এই কথাগুলি আমাদের শক্তি এবং প্রেরণা দেয়। আপনি যদি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষাগুলি নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন, তবে আপনি নিজের ভেতর থেকে এক নতুন শক্তি অনুভব করবেন। শ্রীকৃষ্ণ যে প্রশ্নটি আপনাকে করেন, তা হল:
“তুমি কি সত্যিই জানো, শোক কাকে বলে?”
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আপনি জীবনের প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হবেন। তাই জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে আলিঙ্গন করুন, কারণ প্রতিটি মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা আপনার পাশে রয়েছে।