ভগবদ্ গীতা আমাদের জীবনের গভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি দিকনির্দেশনা। শ্লোক ১২-এ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন,
“ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥”
(অর্থাৎ: কখনোই এমন সময় ছিল না যখন আমি ছিলাম না, তুমি ছিলে না, বা এই রাজারা ছিল না। এবং ভবিষ্যতেও কখনো এমন হবে না যে আমরা কেউই থাকব না।)
এই শ্লোকটি জীবনের অনিত্যতা ও আত্মার চিরন্তন প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে আমি তোমাকে বলব কীভাবে এই শ্লোকের মর্ম জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে।
জীবনের সমস্যা এবং গীতার সমাধান
অনিশ্চয়তা এবং ভয়
আমরা প্রায়ই জীবনের অনিশ্চয়তায় ভুগি। চাকরি হারানোর ভয়, সম্পর্কের টানাপোড়েন, বা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আমাদের গ্রাস করে। তবে শ্রীকৃষ্ণ এখানে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আত্মা চিরন্তন, এবং জীবনের ওঠাপড়াগুলি শুধুমাত্র সাময়িক। গীতায় বলা হয়েছে:
“মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনঃ অনিত্যাঃ তাংস্ তিতীক্ষস্ ত্ব ভারত॥”
(অর্থ: সুখ-দুঃখ, শীত-গ্রীষ্মের মতো আসে এবং যায়। এগুলি সহ্য করতে শেখো।)
তুমি কি কখনো ভেবেছ, ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে অযথা মানসিক শান্তি নষ্ট না করে, তাদের কেবল একটি অধ্যায় হিসেবে দেখলে কেমন হতো? যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মনে করাও যে এটি কেবল একটি অনিত্য পর্ব, এবং শান্ত চিত্তে সেটি মোকাবিলা করো।
সম্পর্কের জটিলতা
জীবনে সম্পর্কের সমস্যাও সাধারণ। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে আমরা মানসিক শান্তি হারাই। এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে, আমরা সবাই চিরন্তন আত্মা, এবং আমাদের সম্পর্ক এই জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। গীতায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক আছে:
“বিদ্যা বিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ॥”
(অর্থ: জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর এবং চণ্ডালের মধ্যে সমান আত্মা দেখতে পান।)
তুমি যদি অন্যদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি রাখো, তাহলে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে। তুমি দেখবে, মানুষকে দোষারোপ করা বা রাগ পুষে রাখা কেমন অপ্রয়োজনীয় মনে হবে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমা এবং সহমর্মিতা সহজ হয়ে যাবে।
মৃত্যুভয়
মৃত্যুভয় আমাদের অনেককেই পঙ্গু করে দেয়। কিন্তু ভগবদ্ গীতা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আত্মা অবিনশ্বর। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“ন জায়তে ম্রিয়তে वा কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা वा ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোऽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥”
(অর্থ: আত্মার কখনো জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না। এটি শাশ্বত এবং অমর। শরীর ধ্বংস হলেও আত্মার ক্ষতি হয় না।)
তুমি কি এমন কাউকে হারিয়েছ যাকে তুমি গভীরভাবে ভালোবাসতে? শোক অবশ্যই প্রাকৃতিক, কিন্তু যদি তুমি বুঝতে পারো যে আত্মা কেবল শরীর বদলায়, তাহলে এটি তোমার বেদনার ভার লাঘব করতে পারে। মৃত্যু জীবনের শেষ নয়; এটি কেবল একটি রূপান্তর।
আত্মবিশ্বাসের অভাব
কখনো কি মনে হয়, “আমি পারব না,” বা “আমার যথেষ্ট যোগ্যতা নেই”? গীতার শ্লোক আমাদের সাহস জোগায়। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“উদ্ধরেত আত্মনাত্মানং ন আত্মানমবসাদয়েত।
আত্মৈব হ্য আত্মনো বন্ধু: আত্মৈব রিপুরাত্মনঃ॥”
(অর্থ: তুমি নিজেই নিজের বন্ধুও, এবং শত্রুও। নিজের মনকে উন্নীত করো, মনকে অবনত হতে দিও না।)
আমরা নিজের ভেতরেই শক্তি ধারণ করি। অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করে, নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাও। নিজেকে বলো, “আমি পারব, কারণ আমার ভেতরেই অনন্ত শক্তি রয়েছে।”
জীবনের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন
অনেকেই ভাবি, “আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী? আমি কেন এখানে আছি?” শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুঃ ভূর্মা তে সঙ্গোऽস্ত্বকর্মণি॥”
(অর্থ: তোমার কর্তব্য শুধু কাজ করা। কাজের ফলে তোমার অধিকার নেই।)
তুমি কি লক্ষ্য করেছ, আমরা প্রায়ই ফল নিয়ে এতটাই চিন্তিত থাকি যে কাজটাই ঠিকভাবে করতে পারি না? এই শ্লোক আমাদের শেখায়, কাজটাই আসল, ফল নয়। যদি তুমি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করো, তাহলে জীবনের প্রতি তোমার হতাশা দূর হবে এবং একটি অর্থবহ জীবনের পথ খুঁজে পাবে।
গীতার পাঠ কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করব
আমরা প্রতিদিন জীবনের যন্ত্রণা, চাপ এবং সংশয়ের মধ্যে দিয়ে যাই। কিন্তু যদি আমরা গীতার এই শাশ্বত জ্ঞানকে গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের চিন্তাধারা এবং জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। নিচে আমি তোমার জন্য কিছু প্রয়োগযোগ্য পরামর্শ দিয়েছি:
- অন্তর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলো।
জীবনের ছোট সমস্যাগুলি নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা না করে সেগুলি সাময়িক বলে গ্রহণ করো। - মানুষকে দোষারোপ বন্ধ করো।
প্রত্যেকেই আত্মা হিসেবে সমান। সবার প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখাও। - ভয়ের পরিবর্তে সাহস চর্চা করো।
মৃত্যুকে চরম সত্য বলে মেনে নাও এবং জীবনকে উপভোগ করো। - তোমার কাজকে ভালোবাসো।
ফলের চিন্তা না করে নিজের দায়িত্বে মনোযোগ দাও।
এক চিরন্তন প্রশ্ন
তুমি কি কখনো ভেবেছ, তুমি কেবল এই শরীর নও, বরং এক শাশ্বত আত্মা? যদি ভেবেছ, তাহলে কীভাবে তোমার চিন্তা, অনুভূতি এবং কাজকে এই সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে?
ভগবদ্ গীতার প্রতিটি শ্লোক আমাদের জন্য এক মহামূল্যবান শিক্ষা। যদি তুমি এটিকে জীবনের অংশ বানাতে পারো, তবে জীবন শুধু সমস্যাহীন নয়, বরং অর্থপূর্ণ এবং আনন্দময় হয়ে উঠবে।
তুমি কি প্রস্তুত এই জ্ঞানের আলোয় নিজের জীবন আলোকিত করতে?