জীবন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। আমরা সবাই এই পরিবর্তনের সত্যটি জানি, কিন্তু প্রায়ই তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। ভগবদ্ গীতার ২য় অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকটি আমাদের জীবনের এই পরিবর্তনকে সহজে বুঝতে এবং মেনে নিতে শেখায়। শ্লোকটি হল:
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।
অর্থাৎ, “যেমন দেহধারী জীব এই দেহে কৌমার (শৈশব), যৌবন ও বার্ধক্য লাভ করে, তেমনই মৃত্যুর পর অন্য দেহ লাভ করে। বিচক্ষণ ব্যক্তি এতে বিচলিত হয় না।”
এই শ্লোকটি আমাকে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। তোমার জীবনের প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি চ্যালেঞ্জ, এমনকি মৃত্যুর মতো বড় সত্য—এসবই প্রাকৃতিক। এটাই জীবন। চল তোমরা আর আমি মিলে এই শ্লোক থেকে শিক্ষা নিয়ে, কীভাবে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো সামলাতে পারি, তা দেখি।
জীবনের পরিবর্তন মেনে নেওয়ার শক্তি
তুমি কি কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছ, যেখানে তোমার প্রিয় কিছু হারিয়েছ? হতে পারে সেটা তোমার প্রিয় মানুষ, একটা সুযোগ, বা তোমার স্বপ্ন। আমি জানি, সেই সময়গুলো কতটা কঠিন। কিন্তু যখন আমি এই শ্লোকটি পড়ি, তখন বুঝতে পারি, পরিবর্তন জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম।
যেমন, একজন কিশোর বড় হয়ে তরুণ হয়, এবং তরুণ থেকে বৃদ্ধ। তুমিও তোমার জীবনে প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছ। তুমি যদি শৈশবেই আটকে থাকতে চাইতে, তাহলে কি আজকের তুমি হতে পারতে? শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শেখাচ্ছেন, পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া আমাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ ১: আমি এক বন্ধুকে জানি, যে চাকরিতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল। নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে না পেরে সে ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে উপলব্ধি করেছিল যে, এই ধাক্কাটি তাকে আরও বড় সুযোগের জন্য প্রস্তুত করছিল। জীবনের এই শিক্ষা শ্রীকৃষ্ণের কথার সঙ্গেই মেলে। দেহ যেমন বদলায়, তেমনই আমাদের পরিস্থিতি বদলায়।
বেদনা কি সত্যি স্থায়ী?
আমরা প্রায়ই ভাবি, দুঃখ, বেদনা, বা কষ্ট আমাদের পিছু ছাড়বে না। কিন্তু তুমি কি জানো, শ্রীকৃষ্ণ গীতার আরেক জায়গায় বলেছেন,
“মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনো অনিত্যাঃ তামস্ তিতিক্ষস্ব ভারত।।”
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখ আসবে-যাবে। এগুলো চিরস্থায়ী নয়। তাই এগুলোকে ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য কর।
আমার মনে পড়ে, আমি যখন কলেজে ছিলাম, তখন পরীক্ষায় একবার খুব খারাপ ফল করেছিলাম। সেই সময় আমি ভেবেছিলাম, সবকিছু শেষ। কিন্তু পরে বুঝলাম, সেই ভুলগুলো আমাকে আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে শিখিয়েছিল। আজ যখন আমি পিছন ফিরে দেখি, বুঝতে পারি, সেই দুঃখ আসলেই সাময়িক ছিল।
কীভাবে জীবনের পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করবে?
তুমি হয়তো ভাবছো, এই জ্ঞান বাস্তবে কেমন কাজে লাগে। এখানে আমি তোমাকে কয়েকটি উপায় বলছি:
নিজের জীবনের গল্প বোঝো
যখনই তুমি কোনো কঠিন সময় পার করছো, নিজেকে বলো, “এটা কেবল আমার জীবনের এক অধ্যায়। এর পরের অধ্যায় আরও ভালো হবে।” এটা বলার জন্য আমি ভগবদ্ গীতার আরেকটি শ্লোক মনে করি:
“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।”
অর্থাৎ, আত্মা কখনও ধ্বংস হয় না। দেহ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু আত্মা চিরন্তন।
তোমার সমস্যাগুলোও দেহের মতো ক্ষণস্থায়ী। এগুলো চিরকাল থাকবে না।
উদাহরণ তৈরি করো
আমি একবার এমন একজন মানুষের গল্প শুনেছিলাম, যিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসাধারণ। তিনি বলতেন, “আমি জানি, আমার শরীর দুর্বল হচ্ছে, কিন্তু আমার মন এবং আত্মা শক্তিশালী।” তার এই মনোভাব তাকে লড়াইয়ে জয়ী করেছিল।
জীবনের সঠিক মানে খুঁজে পাওয়া
তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছো, জীবনের আসল মানে কী? শ্রীকৃষ্ণ আমাদের বলছেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
অর্থাৎ, তোমার কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু কাজের ফলের প্রতি তোমার অধিকার নেই। যখন আমি প্রথম এই শ্লোকটি পড়ি, তখন আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, আমাদের জীবনে অনেক চাপ আসে ফলাফল নিয়ে চিন্তা করার জন্য। যদি আমরা কেবল আমাদের কাজের প্রতি মনোযোগ দিই, তাহলে সেই চাপ অনেকটা কমে যায়।
উদাহরণ
ধরো, তুমি একটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো। যদি তুমি কেবল ফলের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করো, তাহলে তোমার পড়াশোনায় মন বসবে না। বরং যদি তুমি ঠিকভাবে পড়া শেষ করো, ফলাফল আপনার পরিশ্রমের উপর নির্ভর করবে।
জীবনের শেষ কথা
ভগবদ্ গীতার এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সাহায্য করে। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের বলছেন, জীবন পরিবর্তনশীল। দুঃখ-সুখ, শৈশব-বার্ধক্য সবই জীবনের অংশ। এগুলো আমাদের ভয় পাওয়ার জন্য নয়, বরং আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগানোর জন্য।
তুমি যদি এই শ্লোকের মর্ম বুঝতে পারো, তাহলে তোমার জীবনের সমস্ত বাধা অনেক সহজ মনে হবে। আমি শেষ করছি এই প্রশ্ন দিয়ে: তুমি কি জীবনের পরিবর্তনকে ভয় পাবে, নাকি তাকে আলিঙ্গন করবে?
তোমার উত্তরই তোমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।