২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ১৪

২.১৪ঃ সমস্যার মুখমুখি

আমাদের জীবনটা কেমন যেন এক দোলনার মতো। কখনও সুখের চূড়ায়, কখনও দুঃখের গভীরে। আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, কেন জীবনে এমন ওঠাপড়া থাকে? কীভাবে এই সুখ-দুঃখের দোলাচল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? ভগবদ্গীতার চতুর্দশ শ্লোক আমাদের এই প্রশ্নেরই উত্তর দেয়।

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।

গীতার এই শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানিয়েছেন, জীবন হলো ঋতুর মতো, কখনও শীত, কখনও গ্রীষ্ম। সুখ-দুঃখও একইভাবে আসে আর যায়। এগুলো ক্ষণস্থায়ী, নশ্বর। তাই তাদের প্রতি ধৈর্যধারণ করাই হলো প্রকৃত সমাধান। এই শিক্ষাই আপনার জীবনকে পাল্টে দিতে পারে।

আপনার জীবনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া

আমরা সবাই জানি, জীবনে সুখের মুহূর্ত যেমন আসে, তেমনই দুঃখেরও আগমন ঘটে। ধরুন, আপনি একটি চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন এবং অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হননি। কী করবেন তখন? হতাশ হয়ে পড়বেন, নাকি ভগবদ্গীতার এই শ্লোককে মনে রেখে স্থিতধী হয়ে থাকবেন? শ্রীকৃষ্ণ এখানে আমাদের শিখিয়েছেন, “আগমাপায়িনো অনিত্যাঃ” অর্থাৎ, দুঃখ বা ব্যর্থতা আসবে এবং যাবে। তাদের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া মানেই নিজের মানসিক শান্তিকে নষ্ট করা।

আমার এক বন্ধু একবার বড় আর্থিক সমস্যায় পড়েছিল। তার ব্যবসায় বড় ক্ষতি হয়েছিল, এবং সে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু সে গীতার এই শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। সে বলেছিল, “আমি জানি, এই সময়টা স্থায়ী নয়। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব, কারণ প্রতিটি রাতের পর সকাল আসেই।” এবং সত্যিই, কিছুদিনের মধ্যেই সে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে সফল হয়।

প্রতিদিনের জীবনে গীতার ব্যবহার

আমরা সবাই জানি, আমাদের সম্পর্কগুলিতেও অনেক ওঠাপড়া থাকে। কখনও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঝগড়া হয়, কখনও কাছের মানুষের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশিত ভালোবাসা পাই না। এই সময়গুলিতে, গীতার শিক্ষা আপনাকে শক্তি জোগাতে পারে।

ধরুন, আপনি কোনও প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে খুব খারাপ ব্যবহার পেলেন। এমন অবস্থায়, আপনি কি রাগে ফেটে পড়বেন, নাকি এই শ্লোকের উপর ভিত্তি করে ধৈর্য ধরবেন? ভগবান এখানে বলেছেন, “শীত-উষ্ণ” মানে সুখ এবং দুঃখ দুটোই জীবনের অংশ। এগুলোকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমাদের মানসিক অবস্থার উপর সুখ-দুঃখের প্রভাব

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে ধৈর্য ধরব? কীভাবে আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখব? এর জন্য আরও কিছু গীতার শ্লোক আমাদের পথ দেখায়। যেমন, “সমদুঃখসুখং ধীরং সঃ অমৃতত্বায় কল্পতে।” এই শ্লোকে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সুখ-দুঃখে সমান থাকে, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। একবার আমি আমার কাজের জন্য একটি বড় প্রকল্পে পরিশ্রম করছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। প্রথমে খুব হতাশ বোধ করেছিলাম। কিন্তু তখনই গীতার এই শিক্ষাগুলি আমার মনে পড়ে গেল। আমি ভাবলাম, এই ব্যর্থতা কেবলই সাময়িক। আমি নতুন শক্তি নিয়ে আবার চেষ্টা শুরু করলাম। পরবর্তীতে আরও বড় সফলতা অর্জন করেছিলাম।

ধৈর্যের গুরুত্ব

আজকের দ্রুতগতির জীবনে, আমরা চটজলদি ফলাফল চাই। কিন্তু গীতা আমাদের শেখায় ধৈর্য ধরতে। আপনি যদি লক্ষ্য করেন, প্রাকৃতিক ঘটনাগুলিও ধৈর্যের উদাহরণ। একটি ছোট বীজ থেকে মহীরুহ হয়ে উঠতে সময় লাগে। একইভাবে, আমাদের জীবনের সমস্যাগুলির সমাধানেও সময় লাগতে পারে।

ধরুন, আপনার সন্তান পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করছে না। আপনি তার উপর চাপ সৃষ্টি করলে হয়তো সাময়িকভাবে ফল পাবেন, কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য তাকে সময় এবং উৎসাহ দিন। গীতার শিক্ষার মাধ্যমে বোঝান যে, চেষ্টা আর ধৈর্যই সফলতার চাবিকাঠি।

দৈনন্দিন জীবনে ভগবদ্গীতার আরও কিছু শিক্ষা

গীতায় বলা হয়েছে, “যোগঃ কর্মসু কৌশলম।” অর্থাৎ, কর্মে দক্ষতাই যোগ। যখন আপনি কোনও কাজে মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন, তখন তার ফলাফল ভালো হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যদি এই শিক্ষাকে প্রয়োগ করি, তাহলে আমাদের কর্মে আরও সাফল্য আসবে।

এছাড়া, শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেছেন, “তস্য প্রজ্ঞান স্থিরা ভবতি।” যার মন স্থির, সে-ই প্রকৃত জ্ঞানী। যখন কোনও পরিস্থিতি আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়, তখন এই শ্লোকগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্থির মনই আমাদের প্রকৃত শক্তি।

গীতার দর্শনে শান্তির সন্ধান

সুখ এবং দুঃখের এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গীতা আমাদের আরও একটি উপদেশ দেয়। “মা তে সংঘো।স্ত্বকর্মণি।” অর্থাৎ, কাজ করো, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না। আমরা যখন আমাদের কাজের প্রতি পুরো মনোযোগ দিয়ে কাজ করি, এবং ফলাফলের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকি, তখনই আমরা সত্যিকারের শান্তি অনুভব করতে পারি।

জীবন এবং ভগবদ্গীতার গভীরতা

শেষে আমি আপনাকে একটাই প্রশ্ন করতে চাই: জীবনের সুখ-দুঃখের চক্র থেকে আপনি নিজেকে মুক্ত করতে চান কীভাবে? ভগবদ্গীতার শিক্ষার মাধ্যমে আপনি যদি জীবনের এই চক্রকে বোঝেন এবং এগুলি নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করেন, তাহলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আপনার জন্য আনন্দময় হয়ে উঠবে।

তাহলে আসুন, আমরা প্রতিদিন গীতার একটি শ্লোক মেনে চলার প্রতিজ্ঞা করি। ভগবদ্গীতার প্রতিটি শিক্ষা আমাদের জীবনে এক নতুন আলো নিয়ে আসবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top