২.১৫ঃ জীবনে সুখ-দুঃখ কতটুকু

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে॥

এই শ্লোকটি ভগবদ্গীতার একটি চমৎকার জীবনপাঠ। এখানে বলা হয়েছে, যিনি দুঃখ এবং সুখে সমান থাকেন, তাঁকেই প্রকৃত ধীর বা স্থিতপ্রজ্ঞ বলা যায়। এমন একজন মানুষ অমরত্বের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। আসুন এই শ্লোকের বার্তা আমাদের জীবনের বাস্তব উদাহরণ দিয়ে অন্বেষণ করি।

জীবনের সুখ-দুঃখে সমান থাকা: সম্ভব কি?

তুমি কি কখনও ভেবেছ, জীবন কেমন হতো যদি সুখে এবং দুঃখে সমান থাকতে পারতে? শ্লোকের ভাষায়, “সমদুঃখসুখং ধীরং” অর্থাৎ সুখ-দুঃখ উভয়ের প্রতিই সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে, বাস্তব জীবনে এটা কতটা সম্ভব? আমি আমার জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা আর গীতার শ্লোকের উপর ভিত্তি করে তোমার সঙ্গে আলোচনা করব।

১. চাকরির চ্যালেঞ্জ ও ভগবদ্গীতা

আমার এক বন্ধু, অর্পণ, একসময় একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করত। কিন্তু হঠাৎ কোম্পানি থেকে তাকে ছাঁটাই করা হলো। এমন পরিস্থিতি কারোর জন্যই দুঃখজনক। কিন্তু অর্পণ ভেঙে পড়েনি। সে গীতার এই শিক্ষাটিকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছিল – “দুঃখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।” (গীতা, ২:৫৬)।

অর্পণ বুঝেছিল, তার উপর নির্ভর করে তার পরিবার। সে নতুন চাকরির জন্য চেষ্টা করতে শুরু করল, এবং এক বছরের মধ্যেই একটি ভালো পজিশনে কাজ পেল। সে আমাকে বলেছিল, “ভাই, যদি ভগবদ্গীতার শ্লোকগুলো মাথায় না থাকত, আমি হয়তো ভেঙে পড়তাম।”

২. সম্পর্কের টানাপোড়েন

তোমার কি মনে হয়, সম্পর্কের ঝামেলা আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় চাপগুলোর একটি? আমার একবার খুব প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমরা প্রায় এক বছর কথা বলিনি। পরে ভগবদ্গীতার একটি শ্লোক পড়ে আমার চোখ খুলে যায় – “সমদর্শিনঃ” (গীতা, ৫:১৮)। এতে বলা হয়েছে, জ্ঞানী ব্যক্তি সবকিছুকে সমানভাবে দেখেন।

আমি আমার বন্ধুকে প্রথমে ফোন করলাম। কথায় কথায় ভুল বোঝাবুঝি পরিষ্কার হলো। জীবনে যদি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে শিখি, তাহলে সম্পর্কের অনেক সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়।

৩. আর্থিক সমস্যার মোকাবিলা

আমাদের অনেকেই আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হই। আমি নিজে একসময় কঠিন আর্থিক অবস্থার মধ্যে ছিলাম। সেই সময়ে গীতার এই লাইনটি আমাকে ভীষণ সাহস জুগিয়েছিল: “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (গীতা, ২:৫০)।

অর্থাৎ, কাজ করার মধ্যেই দক্ষতা এবং যোগের চর্চা রয়েছে। আমি নিজেকে বলতাম, “যদি আজ কষ্ট করি, কাল নিশ্চয়ই ফল পাব।” এবং সত্যিই তাই হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম আর গীতার শিক্ষার মেলবন্ধনে আমি আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।

৪. আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের গুরুত্ব

ধৈর্য হারানো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। একবার আমার এক ছোট কাজের জন্য অনেক বড় প্রত্যাখ্যান পেতে হলো। তখন মনে পড়ল ভগবদ্গীতার এই শ্লোক – “নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চায়ুক্তস্য ভাবনা।” (গীতা, ২:৬৬)। এতে বলা হয়েছে, যিনি যুক্তি বা ধৈর্য হারান, তিনি জীবনে সঠিক পথ খুঁজে পান না।

আমি শিখেছি, ধৈর্য ধরতে হবে এবং নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আমরা যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখি, তাহলে জীবন কত কঠিনই হোক না কেন, আমরা জয়ী হতে পারি।

৫. জীবনের পরিণাম গ্রহণ করার শিক্ষা

একজন মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফলাফল চাই। কিন্তু গীতায় বলা হয়েছে, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (গীতা, ২:৪৭)।

একবার আমি একটি বড় প্রজেক্টে কাজ করছিলাম, কিন্তু তা সফল হয়নি। এই শ্লোকটি আমাকে শিখিয়েছিল, কাজ করো ফলাফলের জন্য নয়। তখন বুঝলাম, আমাদের পরিশ্রমই আসল, ফলাফল নয়।

ভগবদ্গীতার শিক্ষার আলোকে জীবনের উন্নতি

গীতার এই শিক্ষাগুলি আমার জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শিখিয়েছে। তুমি যদি জীবনে সুখী হতে চাও, তাহলে শিখে নাও কীভাবে দুঃখকে মোকাবিলা করতে হয়। যিনি সুখে এবং দুঃখে সমান থাকেন, তিনি জীবনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।

শেষ কথা

আমাদের জীবন সুখ-দুঃখের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ভগবদ্গীতার এই শিক্ষাগুলি আমাদের শেখায়, কিভাবে এই মিশ্রণকে গ্রহণ করে শান্তিতে থাকা যায়। তুমি কি ভেবে দেখেছ, গীতার শিক্ষা শুধু ধর্মীয় নয়, এটি একটি জীবনব্যবস্থা?

তাহলে আজকের দিনে তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো: তুমি কি সুখে এবং দুঃখে সমান থাকতে শিখেছ?

যদি না শিখে থাকো, তাহলে এখনই গীতার শিক্ষার পথে এগিয়ে যাও। জীবনের আসল অর্থ বুঝে নাও।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top