২.১৬ঃ ভাবো আর নাভাবো

“নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।”
(ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ১৬)

আমরা জীবনে কত সমস্যার মধ্যে পড়ি, কত দ্বিধা আমাদের পিছু ছাড়ে না। কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে কি নেই, বা যা আছে সেটি চিরস্থায়ী কি না—এসব নিয়ে আমরা ভাবি। এই শ্লোকটি সেই চিরন্তন সত্য আর অসত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়।

আমি যখন এই শ্লোকটি পড়ি, তখন উপলব্ধি করি যে আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সমস্যাই আসে অস্থায়ী জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি থেকে। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে আমার এই উপলব্ধি ভাগ করি।

অস্থায়ী আর স্থায়ী: জীবন নিয়ে চিন্তা

এই শ্লোকটি আমাদের শেখায় যে যা সত্যি, যা চিরস্থায়ী, তা কোনোদিন হারায় না। কিন্তু অস্থায়ী জিনিসগুলো, যেমন অর্থ, খ্যাতি, অথবা কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, এগুলো কখনোই স্থায়ী নয়।

ধরো, তুমি একটি চাকরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছো। অনেক চেষ্টা করেও সেই চাকরি পেলাম না। তখন তুমি কী ভাববে? হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভগবদ্গীতা বলে, চাকরি বা তার ফল অস্থায়ী। হয়তো এটি তোমার জীবনের একটি শিক্ষা, যা তোমাকে বড়ো কিছু অর্জনের পথে এগিয়ে দেবে।

সম্পর্কের টানাপোড়েন

আমরা অনেক সময় আমাদের প্রিয়জনের আচরণ নিয়ে কষ্ট পাই। এক বন্ধু হয়তো ভুল বোঝে, অথবা কাছের কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করে। এই পরিস্থিতিতে গীতার শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এইসব অস্থায়ী। সম্পর্কের সত্যিকারের মূল্য হচ্ছে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সমর্থন, যা কোনো সাময়িক সমস্যায় শেষ হয়ে যায় না।

স্বাস্থ্যের সঙ্কট

তোমার যদি হঠাৎ কোনো অসুস্থতা দেখা দেয়, তাহলে তুমি ভাবতে পারো, ‘কেন আমার সঙ্গে এমন হচ্ছে?’ কিন্তু এই শারীরিক কষ্টও অস্থায়ী। ভগবান কৃষ্ণ বলেন, “মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনোऽনিত্যাঃ তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।” (অধ্যায় ২, শ্লোক ১৪)। সুখ ও দুঃখ, শীত আর গ্রীষ্মের মতো আসে এবং যায়। এগুলো সহ্য করাই আমাদের কর্তব্য।

অর্থনৈতিক চাপ

ধরো, ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। তুমি ভাবছো, এবার সব শেষ। কিন্তু গীতার শিখন হলো, এই ক্ষতি চিরস্থায়ী নয়। কৃষ্ণ বলেন, “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়। সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।” (অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৮)। ফলাফলের প্রতি আসক্তি ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজ করো।

সত্যকে চিনতে শিখো

আমরা অনেক সময় সত্যকে দেখি না, শুধু বাইরের ঝলক দেখে বিভ্রান্ত হই। ধরো, তোমার কোনও বন্ধু খুব সফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি জানো না তার জীবনের কঠিন লড়াই। গীতা আমাদের শেখায় সত্যের দিকে তাকাতে। সত্য হলো আমাদের আত্মা, আমাদের নিজস্ব লক্ষ্য।

নিজের সাথে সংগ্রাম

অনেক সময় আমরা নিজের সঙ্গেই লড়াই করি। মনে হয়, আমি কেন এইরকম, অন্যদের মতো কেন নই? তখন ভগবদ্গীতা আমাদের শেখায়, “উদ্ধরেত আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত।” (অধ্যায় ৬, শ্লোক ৫)। তুমি নিজেকে নিজেই উন্নত করো। নিজের প্রতি কঠোর হওয়া ছেড়ে দাও।

জীবন-মৃত্যুর রহস্য

আমাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুকে ভয় পাই। কিন্তু গীতার ভাষায়, “ন জন্যতে ম্রিয়তে বা কদাচিন্।” আত্মা জন্মায় না, মরে না। এটি চিরন্তন। এই উপলব্ধি আমাদের ভয়কে কমিয়ে দেয় এবং জীবনকে সহজ করে তোলে।

তোমার কাছে আমার অনুরোধ

তুমি যখন কোনো সমস্যার মধ্যে পড়বে, ভাববে এটি সত্যিই কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এটি কি চিরস্থায়ী? যদি না হয়, তবে সেটি নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই।

শেষ কথা

আমাদের জীবন চ্যালেঞ্জে ভরা। কিন্তু ভগবদ্গীতা আমাদের শেখায় কীভাবে সেই চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াতে হয়। আজ তুমি যখন গীতার এই শ্লোকটি পড়লে, আমি চাই তুমি নিজের জীবনে একবার ভাবো—কোনটি সত্যি, কোনটি অস্থায়ী?

তুমি কীভাবে তোমার জীবনে গীতার জ্ঞানকে কাজে লাগাবে?

(“তোমার অন্তরের সত্যকে চিনতে তুমি কি প্রস্তুত?”)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top