অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥১৭॥
শ্লোকটি আমাদের জীবনের গভীর সত্য তুলে ধরে। “অবিনাশি” বলতে এমন এক সত্ত্বার কথা বলা হয়েছে যা ধ্বংস হয় না, আত্মা। এই আত্মা সর্বত্র বিস্তৃত এবং চিরন্তন। এর বিনাশ অসম্ভব।
যখন আপনি এটি উপলব্ধি করবেন, তখন জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে সহজে মোকাবিলা করতে পারবেন। আমরা প্রায়ই দুঃখ, হতাশা বা ক্ষতির মুখোমুখি হই। কিন্তু এই শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা কেবল এই সাময়িক দুঃখগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নই; আমাদের আত্মা চিরন্তন, যা এসব সীমার বাইরে।
জীবনের বাস্তব উদাহরণ ও শ্লোকের প্রাসঙ্গিকতা
১. ব্যর্থতা ও আশা
আপনার জীবনে কখনো কি এমন হয়েছে যে, কোনো কাজে বারবার চেষ্টা করেও সফল হননি? হয়তো চাকরির ইন্টারভিউয়ে বারবার বাদ পড়েছেন, অথবা একটি ব্যবসা শুরু করে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই সময়ে আপনি যদি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোকটি স্মরণ করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, আপনার আত্মার প্রকৃত সত্ত্বা ধ্বংস হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“তাসামি অদ্যান্তবন্তঃ কন্টেয়া সুখা দুখা সমাগমা।”
অর্থাৎ, দুঃখ ও সুখ সাময়িক এবং তা আমাদের আসল সত্তাকে প্রভাবিত করে না।
একবার আমি একটি বড় প্রজেক্টে কাজ করছিলাম, যা পরিশেষে ব্যর্থ হয়। সেই সময় নিজেকে ভীষণভাবে প্রশ্ন করেছিলাম: “সব চেষ্টা বিফলে গেল?” তখন গীতার এই শ্লোক মনে পড়ল এবং নিজেকে বললাম: “আমার চেষ্টা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আমার আত্মা চিরন্তন।” ব্যর্থতার এই ধাক্কা কাটিয়ে নতুন কিছু শুরু করতে সাহস পেয়েছিলাম।
২. সম্পর্কের টানাপোড়েন
আমাদের জীবনে প্রিয়জনদের সঙ্গে অনেক ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি হয়। কেউ যদি আপনাকে আঘাত করে বা কোনো কারণে সম্পর্ক ভেঙে যায়, আপনি কি ভেবেছেন যে, “এটাই শেষ”?
গীতার ভাষায়:
“সমদুঃখসুখং ধীরং সঃ অমৃতত্ত্বায় কল্পতে।”
অর্থাৎ, সুখ-দুঃখের মধ্যে যে ধৈর্য ধরে রাখতে পারে, সে প্রকৃত মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।
একবার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায়। সেই সময় ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু গীতার এই জ্ঞান আমাকে শিখিয়েছিল যে, আমি চিরন্তন; আমার আত্মার মূল্য এই সাময়িক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে না। এই উপলব্ধি আমাকে ধীরে ধীরে মানসিক শান্তি ফিরিয়ে দেয়।
৩. আর্থিক সমস্যায় হতাশা
ধরা যাক, আপনি বড় ধরনের আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। হয়তো চাকরি হারিয়েছেন বা ঋণে ডুবে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে মনে হতে পারে, “এবার সব শেষ।”
এই সময়ে গীতার শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
“মা তে সঙ্গোস্ত্বকর্মণি।”
অর্থাৎ, কাজের ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজের কর্তব্য পালন করো।
আমি একবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম যখন মনে হচ্ছিল সব পথ বন্ধ। কিন্তু এই শ্লোক আমাকে শিখিয়েছিল যে, আমার কাজ হলো পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া, ফল ভগবানের হাতে। এর ফলে আমি ধীরে ধীরে আমার সমস্যা কাটিয়ে উঠেছিলাম।
৪. ভবিষ্যতের ভয়
আমরা অনেক সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে এত চিন্তা করি যে, বর্তমান মুহূর্ত উপভোগ করতে ভুলে যাই। চাকরি, পড়াশোনা, বা জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে আমাদের মনের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।”
অর্থাৎ, ফলের আশা ত্যাগ করে নিজের কর্তব্য পালন করো।
এই শ্লোক আমাকে বারবার শিখিয়েছে যে, ভবিষ্যতের অজানা ভয়ের জন্য বর্তমানকে নষ্ট করা উচিত নয়। আমাদের কাজ করে যেতে হবে এবং ফল ভগবানের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
শ্লোকের পাঠ: কিভাবে জীবনকে উন্নত করা যায়
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে, আমাদের অস্তিত্ব কেবল শরীর বা মানসিক অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা চিরন্তন, অবিনাশী আত্মা। তাই যেকোনো প্রতিকূলতাকে সামলানোর জন্য এই জ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়।
আপনার জীবন যতই জটিল হোক না কেন, মনে রাখবেন:
“ন যায়তে মৃয়তে বা কদাচিত্।”
অর্থাৎ, আত্মার কোনো জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। এটি চিরন্তন এবং অবিনাশী।
শেষ কথা: আপনি কি প্রস্তুত?
আপনার জীবনের যে সমস্যা-ই আসুক না কেন, গীতার এই শিক্ষাগুলি আপনাকে সবসময় শক্তি এবং প্রেরণা দেবে। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কি গীতার শিক্ষাকে আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে প্রস্তুত?
“আপনি কি আপনার আত্মার সত্যিকারের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন?”