২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ৩

২.৩ঃ আমাদের জীবনে “অর্জুন মুহূর্ত”

“ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরমন্তপ॥”

অর্থাৎ, “হে অর্জুন! দুর্বলতা বা কাপুরুষতার বশবর্তী হয়ো না। এটি তোমার মতো মানুষের পক্ষে শোভা পায় না। হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতাকে ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও, হে পরাক্রমশালী!”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথাগুলো বলেছিলেন মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে, যখন অর্জুন একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। আজকের এই আধুনিক সময়েও এই শ্লোকের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন চলার পথে আমাদেরও অনেক সময় অর্জুনের মতো হতাশা, দ্বিধা এবং ভয়ের মুখে পড়তে হয়। শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী যেন আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে নবজাগরণ আনে।

জীবনের দুর্বলতা: আমাদের “অর্জুন মুহূর্ত”

আমাদের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে, যখন সবকিছু ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে। আপনি হয়তো পরীক্ষায় ফেল করেছেন, চাকরিতে পদোন্নতি হয়নি, ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে বা কোনো সম্পর্ক ভেঙে গেছে। মনে হয়, “আমি পারবো না”। কিন্তু এই “পারবো না” ভাবটাই আসলে আমাদের মনোবলকে ভেঙে দেয়।

একবার ভাবুন, অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে হবে। তার দুর্বলতা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন—

“দুর্বলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করো। শক্তি এবং সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যাও।”

আমাদের জীবনেও এই কথাগুলো সমান প্রাসঙ্গিক। জীবনের যে কোনো সমস্যার সময় একবার নিজের হৃদয়ে বলুন, “আমি দুর্বল নই, আমি পারবো।”

একটি বাস্তব উদাহরণ: স্টিভ জবসের জীবনযুদ্ধ

আমরা স্টিভ জবসের জীবন সম্পর্কে জানি। তিনি যখন অ্যাপল থেকে বহিষ্কৃত হলেন, তখন তাঁর আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু তিনি দুর্বলতা কাটিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি আরও বড় সাফল্য এনে দেন অ্যাপলের জন্য।

তাঁর জীবনে এই কথা যেন সত্যি ছিল—

“উদ্ধরেণ আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্।”
অর্থাৎ, “নিজেকে নিজেই উন্নত করো, কারণ নিজেকেই নিজের বন্ধু হতে হবে। নিজের চিন্তার দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিও না।”

এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে ব্যর্থতা আসবে, কিন্তু দুর্বলতা ধরে বসে থাকলে কিছুই সম্ভব হবে না।

আপনার জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র: সংকটের সামনে দাঁড়ানো

আমাদের জীবনে অনেক সময় পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে আমাদের শিখতে হবে।

  •  চাকরি বা পড়াশোনার চাপ:
    ধরুন, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। তখন মনটা ভেঙে পড়বে। মনে হবে, “আমার দ্বারা আর কিছু হবে না।” ঠিক তখনই মনে করুন গীতার এই শ্লোক—

“হে পার্থ! হৃদয়ের দুর্বলতাকে দূর করো।”

পরিশ্রমের মাধ্যমে আপনি আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন। পরীক্ষার রেজাল্ট শেষ নয়, বরং এটি নতুন শুরু।

  •  সম্পর্কের সংকট:
    কখনো কখনো প্রিয়জনের সঙ্গে ঝগড়া বা বিচ্ছেদ আমাদের ভেতরটাকে দুর্বল করে দেয়। মনে হতে পারে জীবন থেমে গেছে। কিন্তু এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে—

“বদলে যাওয়া পরিস্থিতির কাছে নিজেকে দুর্বল করে দিও না। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার নিজের শক্তি প্রমাণ করো।”

  • অর্থনৈতিক সমস্যায় ভেঙে পড়া:
    ব্যবসায় ক্ষতি বা অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লে অনেকেই দিশেহারা হয়ে যান। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর সব সফল মানুষ কঠিন সময় পার করেই জয়ী হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের বাণী মনে রেখে আমাদের মনে বল রাখতে হবে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা: মনের শক্তি দিয়ে জীবন বদলানো

গীতায় আরও বলা হয়েছে—

“সমত্বং যোগ উচ্চ্যতে।”
অর্থাৎ, সমতা বজায় রাখা—সুখে-দুঃখে, লাভ-ক্ষতিতে মনের ভারসাম্য ধরে রাখা।

কখনো সুখের সময় অহংকারে ভেসে যাবেন না, আবার দুঃখের সময় দুর্বল হয়ে পড়বেন না। অর্জুনের মতো আমরাও যদি শ্রীকৃষ্ণের এই বাণীকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে দেখবেন সমস্ত সংকট পেরিয়ে সফলতা আসবেই।

একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প: সলোমনের আংটি

একবার রাজা সলোমন একটি আংটি তৈরি করতে বললেন যার মাধ্যমে সুখের সময় অহংকার কমে যাবে এবং দুঃখের সময় শক্তি পাবেন। সেই আংটিতে লেখা ছিল—

*“এই সময়টিও চলে যাবে।”

আমাদের জীবনের সব দুর্বলতা ও সমস্যা আসলে সাময়িক। সময়ের সাথে সব বদলে যায়। গীতার শিক্ষাও ঠিক তাই—

“নিত্যানিত্যনা ভোগা।”
অর্থাৎ, জীবনের দুঃখ-কষ্ট ক্ষণস্থায়ী। এগুলোকে জয় করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

জীবনে গীতার শ্লোক প্রয়োগ: কয়েকটি পরামর্শ

  •  প্রতিদিন একবার গীতার শ্লোক পড়ুন। মনকে শক্তিশালী রাখতে গীতার কোনো একটি উপদেশ মনে রাখুন।
  •  যে কোনো সংকটে নিজেকে প্রশ্ন করুন: “এটা কি আমার ‘অর্জুন মুহূর্ত’? আমি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি?”
  •  মেডিটেশন বা ধ্যান করুন: গীতার শিক্ষা ধীরে ধীরে আত্মস্থ করতে ধ্যানের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  •  প্রতিদিন নিজের সাথে কথা বলুন: “আমি দুর্বল নই। আমি পারবো।”

শেষ কথা: আপনি কি আজ শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোক শুধু অর্জুনের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য। জীবনের প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের ভয়কে জয় করতে হবে, দুর্বলতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগোতে হবে।

একবার নিজের মনের মধ্যে বলুন—

“ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ করো। আমি শক্তিশালী। আমি পারবো।”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি আজ আপনাকে বলছেন— “উঠে দাঁড়াও, হে পরমান্তপ”?

আপনার উত্তর কী? জীবন কি আজই বদলাতে শুরু করবে?

*“তোমার দুর্বলতাকে ছুঁড়ে ফেলো, এবং শক্তির সাথে জীবনের দিকে এগিয়ে যাও।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top