অর্জুন উবাচ
কথং ভীস্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন ।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন ॥৪॥
অর্থ:
অর্জুন বললেন, হে মধুসূদন! হে অরিসূদন! আমি কিভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্যের মতো পূজ্যজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করব?
ভগবদ গীতা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি আমাদের জীবনের চলার পথে পথপ্রদর্শক। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের এই অসাধারণ কথোপকথনে আমরা প্রতিটি শ্লোকে এমন গভীর শিক্ষা পাই, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করলে জীবন সত্যিই বদলে যেতে পারে। এই শ্লোকটিতে অর্জুনের দ্বিধা ও মানসিক দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। যুদ্ধে তাকে এমন লোকদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যাদের তিনি ছোটবেলা থেকে শ্রদ্ধা করে এসেছেন।
আমাদের জীবনেও এমন পরিস্থিতি আসে, যখন আমরা এমন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হই, যেখানে হৃদয় বলে এক কথা আর কর্তব্য বলে আরেক কথা। তাহলে কী করব তখন? এই শ্লোকের মাধ্যমে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি পথ খুঁজে নিতে পারি।
জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তের দ্বিধা
আপনার জীবনে কি এমন সময় এসেছে, যখন আপনার সামনে দুই রকমের পথ ছিল? একদিকে আপনার নিজের অনুভূতি, ভালোবাসা এবং সম্পর্ক, অন্যদিকে কর্তব্য এবং সত্য?
একবার ভাবুন, একজন ছাত্র তার পরীক্ষার আগের রাতে বন্ধুদের সাহায্য না করে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিলে কি সে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে? আবার একজন ডাক্তার যদি কঠিন অপারেশন না করেন, কারণ তার রোগী তার প্রিয়জন, তবে কি সেটা ন্যায়সঙ্গত হবে?
অর্জুনের মতো আমাদেরও দ্বিধার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু ভগবদ গীতা আমাদের শেখায় কীভাবে সেই দ্বিধা কাটিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে হয়।
প্রথম শিক্ষা: কর্তব্যের পথে অবিচল থাকা
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ” (গীতা ৩.৩৫)
অর্থাৎ, নিজের কর্তব্য পালন করাই শ্রেষ্ঠ। অন্যের পথ অনুসরণ করলে ভয়ানক বিপদের সম্ভাবনা থাকে।
অর্জুনের সামনে যুদ্ধের কঠিন কর্তব্য ছিল। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলেন কারণ তার প্রতিপক্ষ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য্যের মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা ছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাকে মনে করিয়ে দেন যে তার একমাত্র কর্তব্য ধর্মের পথে থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
তোমার জীবনেও এমন পরিস্থিতি আসবে। তখন তুমি কি করবে? যদি তোমার কর্তব্য তোমার প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, তুমি কি তা পালন করবে? মনে রেখো, সঠিক কাজ করতে গেলে কখনও কখনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।
দ্বিতীয় শিক্ষা: মানসিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠুন
কতবার এমন হয়েছে যে তুমি মানসিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত? কখনও কখনও আমাদের মন বলে, “এটা ঠিক হবে না”, আর আবার যুক্তি বলে, “এটাই সঠিক।”
শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে বুঝিয়েছিলেন যে মানসিক দ্বন্দ্বের মূল কারণ আমাদের মায়া এবং অজ্ঞানতা। আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে গেলে মনে হয় আমরা পাপ করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রকৃত পাপ হল অন্যায়ের পাশে দাঁড়ানো।
তৃতীয় শিক্ষা: ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ
“অশান্তস্য কুতঃ সুখম্?” (গীতা ২.৬৬)
অর্থাৎ, যার মন শান্ত নয়, সে কখনও সুখী হতে পারে না।
অর্জুনের মন তখন অশান্ত। আমাদের মনও যখন অশান্ত হয়, তখন আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কিন্তু যদি তুমি ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারো, নিজের আবেগকে সামলাতে পারো, তাহলে তোমার দ্বিধা দূর হবে।
একজন সফল ব্যক্তি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়? তিনি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে, যুক্তির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীকৃষ্ণ এই গুণ অর্জুনকে শেখাতে চেয়েছিলেন।
প্রাসঙ্গিক উদাহরণ
- একজন শিক্ষক:
একজন শিক্ষক জানেন যে তার ছাত্র তার আত্মীয়স্বজন। তবুও তিনি পরীক্ষার খাতায় অন্যায় নম্বর দিতে পারেন না। কারণ তার কর্তব্য সঠিক মূল্যায়ন করা। - একজন বিচারক:
একজন বিচারকের সামনে যদি তার আত্মীয়ের মামলার রায় আসে, তিনি কি পক্ষপাত করবেন? না, তার কর্তব্য হল ন্যায়বিচার করা। - একজন অফিসার:
একজন পুলিশ অফিসার যদি তার কোনো প্রিয়জনের অন্যায় কাজ দেখে, তবে কি তিনি তাকে ছেড়ে দেবেন? না, তার কর্তব্য হল অপরাধ দমন করা।
এগুলো আমাদের জীবনে বাস্তব উদাহরণ। আমরা যদি গীতার শিক্ষা মনে রেখে চলি, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্তও সহজ হয়ে যাবে।
গীতার নির্দেশনা: কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?
- সত্যের পথ অনুসরণ করুন।
- আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিন।
- আপনার কর্তব্যই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
- অন্যায়ের পাশে কখনও দাঁড়াবেন না।
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সংগং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।” (গীতা ২.৪৭)
অর্থাৎ, ফলের আশা ছেড়ে কর্তব্য পালন করো।
তুমি যদি নিজের কাজে সত্যনিষ্ঠ থাকো, তাহলে তোমার সিদ্ধান্তও সঠিক হবে।
শেষ কথা: দ্বিধা কাটিয়ে সঠিক পথে এগোনো
জীবনে অনেক কঠিন সময় আসবে, যখন মনে হবে তুমি এগোতে পারবে না। তখন শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোকগুলো তোমাকে পথ দেখাবে। দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার চাবিকাঠি হল নিজের কর্তব্য পালন করা, সত্যের পথ অনুসরণ করা।
একবার ভেবে দেখো, আজ তুমি জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় আছো? গীতার এই শ্লোক কি তোমাকে সেই দ্বিধা কাটাতে সাহায্য করতে পারে না?
“জীবনের সব যুদ্ধ অস্ত্র দিয়ে জেতা যায় না, কিছু যুদ্ধ নিজের মন ও সত্যের শক্তি দিয়ে জেতা হয়।”
তোমার জীবনের যুদ্ধ কি তুমি লড়তে প্রস্তুত? শ্রীকৃষ্ণ তোমার পাশে আছেন, ঠিক যেমন তিনি অর্জুনের পাশে ছিলেন। গীতা খুলে দেখো, উত্তর ঠিক সেখানেই আছে।
“তোমার কর্তব্য পালন করো, বাকিটা শ্রীকৃষ্ণের হাতে ছেড়ে দাও।”