২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ৫

২.৫ঃ জীবনের বাস্তব পরিস্থিতি

বন্ধুরা, জীবন অনেক সময় এমন পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করায়, যেখানে আমাদের মনে হয়, কোন পথ সঠিক? কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত? আজ আমরা ভগবদ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের শ্লোক ৫ নিয়ে আলোচনা করব। এই শ্লোকটি শুধু শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন নয়, আমাদের জীবনের জন্য একটি বাস্তব পথনির্দেশিকা।

শ্লোকটি কী বলে?

“গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব
ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ ॥”

অর্থ:
অর্জুন বলছেন, “গুরুদের হত্যা না করে এই পৃথিবীতে ভিক্ষা করে খাওয়া অনেক ভালো। কিন্তু যদি তাদের হত্যা করি, যারা লোভ ও ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ করতে চায়, তাহলে সেই সুখও হবে রক্তে ভেজা। এমন ভোগে কী শান্তি আছে?”

প্রথমে বোঝা যাক শ্লোকের অন্তর্নিহিত বার্তা

এই শ্লোকে অর্জুন এক গভীর দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়েছেন। তিনি ভাবছেন, নিজের শ্রদ্ধেয় গুরু এবং আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কি সঠিক? যুদ্ধ জিতে যদি ভোগ করা যায়, তবুও সেই ভোগ কি সত্যিকারের সুখ এনে দিতে পারে? এ প্রশ্ন শুধুমাত্র অর্জুনের নয়, আমাদের জীবনেও বারবার আসে।

আমাদের জীবনে যখন কোনো কঠিন সিদ্ধান্তের মুখে দাঁড়াই, তখন ভগবদ গীতার শিক্ষা আমাদের দেখিয়ে দেয় সঠিক পথ।

আপনার জীবনের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে দেখুন

আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন কিছু সময় আসে, যখন নৈতিকতা ও দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়।

উদাহরণ : পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব

ধরুন, আপনার ব্যবসায়িক সমস্যার জন্য পরিবারের সদস্যদের সাথে বিরোধ দেখা দিল। এই সময় আপনি ভাবছেন, সম্পর্কের দাম বেশি না নিজের ন্যায়ের? অনেক সময় ন্যায়ের জন্য কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়, কিন্তু মনে রাখা উচিত, সেই সিদ্ধান্ত যেন অহংকার বা লোভ থেকে না আসে। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, নিজের কর্তব্যের পথে থাকো, কিন্তু অহংকার থেকে মুক্ত থাকো।

গীতায় বলা হয়েছে:
“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”
(কর্মে দক্ষতা ও সততা হল সত্যিকারের যোগ।)

উদাহরণ : নৈতিকতা বনাম বাস্তবতা

আমরা অনেক সময় ন্যায়বিরোধী কাজ করতে বাধ্য হই নিজের জীবিকার জন্য। কিন্তু এই জীবিকা যদি আমাদের মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে মনে শান্তি থাকে না। অর্জুনও ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার কথা বলেছিলেন, কারণ তাঁর কাছে গুরুদের হত্যা অর্থহীন মনে হচ্ছিল।

শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু তখন তাঁকে বলেন, ভিক্ষা নয়, নিজের ধর্ম অনুযায়ী কর্তব্য পালন করাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

গীতার আরেকটি শিক্ষা:
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ”
(নিজের ধর্ম পালন করে মৃত্যু হলেও তা উত্তম; পরের ধর্ম অনুকরণ করা ভয়ংকর।)

উদাহরণ : ক্যারিয়ার চয়েস ও মূল্যবোধ

একজন ছাত্রের কথা ভাবুন, যার সামনে দুটি অপশন। একদিকে একটি চাকরি যা প্রচুর টাকা দেবে, কিন্তু সেখানে নৈতিকতা নেই। অন্যদিকে এমন একটি চাকরি, যেখানে নৈতিকতার মান রক্ষা হবে, কিন্তু আয় কম। আমরা কী বেছে নেব?

এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভগবদ গীতার এই শ্লোক আমাদের শেখায়, মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে অর্জিত সুখ কখনোই প্রকৃত সুখ নয়।

ভগবদ গীতার নীতিগুলি কীভাবে কাজে লাগাবেন?

১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি করুন

যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন—
“আমার এই সিদ্ধান্ত কি আমার নৈতিকতার সাথে মিলছে?”

গীতায় বলা হয়েছে—
“অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়।”
(অসত্য থেকে সত্যের দিকে যাও, অন্ধকার থেকে আলোয় যাও।)

২. অহংকার ও লোভ থেকে মুক্ত থাকুন

অনেক সময় আমরা লোভ বা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যার পরিণতি সুখকর হয় না। অর্জুনের মতো আপনিও প্রশ্ন করুন—
“এই সিদ্ধান্ত কি আমাকে শান্তি দেবে?”

৩. কর্তব্যপালনই শ্রেষ্ঠ ধর্ম

জীবনে যে দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়েছে, তা নিষ্ঠার সাথে পালন করাই সত্যিকারের ধর্ম।

গীতার শিক্ষা:
“নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্ ন ক ইহ প্রীতিঃ”
(অন্যের ক্ষতি করে পাওয়া জয় অর্থহীন।)

গীতার শিক্ষা জীবনের পথে আলো দেখায়

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। আমি নিজেও অনেক সময় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। কিন্তু যখনই গীতার শ্লোক পড়েছি, মনে হয়েছে যেন শ্রীকৃষ্ণ নিজে এসে আমাকে বলছেন, “এই পথ ধরো, এটাই তোমার কর্তব্য।”

উপসংহার: আপনার জীবনের শ্রীকৃষ্ণ কে?

এই শ্লোক আমাদের একটি শক্তিশালী শিক্ষা দেয়— সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজের অন্তরের কথা শুনুন, অহংকার এবং লোভ থেকে দূরে থাকুন। মনে রাখবেন, কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই আমাদের প্রকৃত শক্তি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top