“ন চৈতদ্ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ্ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্
তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ ॥৬॥”
আমাদের জীবনের প্রতিদিনের পথচলায় আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যেখানে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কখনও তুমি দ্বিধাগ্রস্ত থাকো, কখনও মনে হয় যে যা-ই করো, ফলাফল অনিশ্চিত। এই শ্লোকটি এমনই এক মানবিক অনুভূতির প্রতিফলন। অর্জুনের প্রশ্ন এখানে আমার আর তোমার মতো যে কারোরই হতে পারে—কোনটি সঠিক? কোন পথে এগোলে জীবনে সার্থকতা আসবে?
এই সংকটের সময়েই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষা আমাদের জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে শেখায়। আমি আজ তোমার সঙ্গে এই শ্লোকের মর্ম বোঝার চেষ্টা করব এবং জীবনে কিভাবে এই শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করা যায় তা আলোচনা করব।
সংকটের মধ্যেই সমাধান খুঁজে পাওয়ার পাঠ
আমরা অনেক সময় এমন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হই, যেখানে সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার হিসাব করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেমন, তুমি হয়তো একটি নতুন কাজ শুরু করতে চাইছ, কিন্তু ভয় পাচ্ছ যে সফল হবে কিনা। এমন পরিস্থিতিতে আমি নিজেও ভেবেছি, “যদি হারি? যদি ব্যর্থ হই?”
শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে বলতে চেয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেবার আগে ফলাফল নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট কোরো না। কর্ম করাই মানুষের ধর্ম। গীতার আরেকটি শ্লোক এখানে আমাদের সহায়তা করতে পারে:
“কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (গীতা ২.৪৭)
অর্থাৎ, তোমার অধিকার আছে শুধু কর্মে, কিন্তু ফলাফলের উপর নয়। তাই সৎভাবে কর্ম করো, ফলাফলের চিন্তা করো না।
তুমি যদি সৎভাবে চেষ্টা করো, তবে যা ঘটবে তা তোমার মঙ্গলের জন্যই ঘটবে।
তোমার জীবন এবং সিদ্ধান্ত
একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক, তুমি এমন একজন ডাক্তার হতে চাও, যে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সেবা করবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তোমাকে বহু বছর পড়াশোনা করতে হবে, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। এই সময় তুমি হয়তো ভাববে, “আমি কি সফল হব? এত কষ্টের পরেও কি আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব?”
এই শ্লোকটি তোমাকে মনে করাবে যে, জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলিতে ফলাফল নয়, কর্মটাই গুরুত্বপূর্ণ। তুমি যদি নিজের পথে অবিচল থাকো, তবে সফলতা তোমার পথে আসবেই। অর্জুনের মতো আমরাও কখনও কখনও ভয় পাই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শেখান, ভয়কে জয় করে এগিয়ে যেতে।
সংশয়কে জ্ঞান দিয়ে জয় করো
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক এখানে প্রাসঙ্গিক:
“সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।” (গীতা ৪.৪০)
অর্থাৎ, সংশয়ে আচ্ছন্ন ব্যক্তি সর্বদা ভোগান্তিতে থাকে। তোমার যদি কোনো পরিকল্পনা থাকে, তবে তার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে সংশয়ে ভোগার প্রয়োজন নেই। বরং পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের উপর জোর দাও।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যখন আমি কোনো বড় কাজের মুখোমুখি হই, তখন সংশয় আমার সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু আমি যদি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকি এবং মনোযোগ সহকারে চেষ্টা করি, তবে সংশয় দূর হয়ে যায়।
পরিবার ও সম্পর্কের সংকটে গীতার পাঠ
তোমার হয়তো মনে হতে পারে যে তোমার কোনো সিদ্ধান্তের প্রভাব তোমার প্রিয়জনদের উপর পড়বে। যেমন অর্জুনের মনে হয়েছিল কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার চেয়ে তাদের হত্যা করা অনেক বড় পাপ। তেমনই হয়তো তুমি কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছ।
গীতা এখানে বলে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই আত্ম-উন্নয়ন এবং বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করো। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“যৎপ্রভার্তমানানং বুদ্ধির্জ্ঞানমপোহতি।” (গীতা ৩.১৬)
অর্থাৎ, কর্মই সবকিছুর মূল। তুমি যদি সৎ থাকো এবং তোমার কাজের মাধ্যমে মঙ্গলের পথে চলতে থাকো, তবে দীর্ঘমেয়াদে তার ফল ভালোই হবে।
তোমার পথচলা এবং আত্মবিশ্বাস
এই শ্লোকটি আমাকে এবং তোমাকে মনে করিয়ে দেয়, জীবনের কোনো সংকটে হাল ছেড়ে দেওয়া সঠিক পথ নয়। বরং পরিস্থিতিকে বুঝে, নিজের দায়িত্ব পালন করাই আমাদের ধর্ম।
তুমি কি কখনও নিজেকে প্রশ্ন করেছ: “আমি কি সঠিক পথে আছি?” যদি করেও থাকো, এই শ্লোক তোমাকে উত্তর দেবে—পথ সঠিক কিনা তা জানার দায়িত্ব তোমার নয়। সৎভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করাই তোমার প্রধান কর্তব্য।
শেষ কথা
তোমার জীবনে যখনই কোনো কঠিন সময় আসে, মনে রেখো গীতার এই কথাগুলি। সৎভাবে কাজ করে যাও, ফলাফলের চিন্তা কোরো না। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।
শেষে আমি একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই: তোমার জীবনের সংকটের মুখে তুমি কীভাবে গীতার এই শিক্ষা প্রয়োগ করবে?
তোমার জীবনকে সুন্দর এবং মঙ্গলময় করার জন্য গীতার শিক্ষা সবসময় তোমার পাশে থাকবে। “যদি কোনো সময় মনে হয় তুমি একা, মনে রেখো, গীতা তোমার সঙ্গী।”